আল্লাহর সৈনিক ও দলীয় ক্যাডার

ফিরোজ মাহবুব কামাল

 

আল্লাহর সৈনিকদের পরিচয়: একতার তাড়না

মুসলিম হওয়ার অর্থ শুধু নামাজী, রোজাদার ও হাজী হওয়া নয়, বরং আল্লাহর সৈনিক হওয়া। আর যে আল্লাহর সৈনিক হতে ব্যর্থ হয়, তাকে শয়তানের সৈনিক হতে হয়। কারণ, তার জন্য মহান আল্লাহ তায়ালা আর কোন রাস্তা খোলা রাখেননি। কারণ মহান আল্লাহ তায়ালা কাছে মানব জাতির বিভাজনটি দুই ভাগে: এক). হিযবুল্লাহ তথা আল্লাহর সৈনিকদের দল, দুই). হিযবুশ শায়তান তথা শয়তানের সৈনিকদের দল। এ বিভাজনের ঘোষণাটি এসেছে পবিত্র কুর’আনে। আর কে আল্লাহর সৈনিক, আর কে দলের শৃঙ্খলিত ক্যাডার -সেটি বুঝাতে গবেষণার প্রয়োজন পড়ে না।

আল্লাহর সৈনিককে চেনা যায় তার মাঝে মুসলিমদের মাঝে একতা গড়ার প্রবল তাড়না দখে। যার মধ্য সে তাড়না নাই সে নামাজী, রোজাদার ও হাজী হতে পারে, তবে সে আল্লাহ সৈনিক হতে পারে না।  মহান আল্লাহ তায়ালার দ্বীনকে যে ব্যক্তি রাষ্ট্রের বুকে বিজয়ী করতে চায়, সে প্রতিক্ষণ বাঁচে অন্য মুসলিমদের সাথে একতা গড়ায় তাড়না নিয়ে। কারণ সে জানে, একতা ছাড়া বিজয় অসম্ভব। তাছাড়া সে ব্যক্তি জানে, একতা গড়া নামাজ-রোজার ন্যায় ফরজ; এবং অনৈক্য গড়া ব্যভিচার বা মদ্যপানের ন্যায় হারাম। এবং সে এটিও জানে অনৈক্য মহান আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে ভয়ানক আযাব ডেকে আনে -যার প্রতিশ্রুতি শোনানো হয়েছে সুরা আল ইমরানের ১০৫ নম্বর আয়াতে। তাই যেসব আল্লাহর সৈনিক পবিত্র  কুর‌’আন থেকে নির্দেশ নেয়, তাদেরকে একতাবদ্ধ করতে অতীতে কোন দল গড়তে হয়নি। ঈমানের রশি তাদের একত্রিত করে ফেলেছে। সেটি ১৯৭৯ সালের ইরান বিপ্লবে দেখা গেছে। সেটি দেখা গেছে স্বৈরাচার বিরোধী আরব বসন্তে। দেখা গেছে ফ্যাসিস্ট হাসিনার বিরুদ্ধে বাংলাদেশেও।

অপর দিকে যারা ব্যক্তি দল, মাজহাব, পীর বা ফিরকার জন্য কাজ করে, তারাই একতার  শত্রু। তারা আল্লাহর দ্বীনের বিজয়ের চেয়ে দলের বিজয় এবং দলের স্বার্থ দেখে। অন্যদের সাথে একতা গড়ার মাঝে তারা নিজ দল, নিজ ফিরকা, নিজ মজহাব ও নিজ পীরমুরিদীর বিলুপ্তির সম্ভাবনা দেখে। তাই তারা একতার কথা মুখে আনে না। বাংলাদেশের মত মুসলিম দেশগুলিতে ইসলামের পরাজয়ের মূল কারণ তো এখানেই। এসব দেশে ইসলামের নামে অসংখ্য দল গড়ে উঠলেও, তাদের মাঝে একতা গড়ে উঠেনি। বরং বিভক্তি বেড়েছে। তারা নিজেদের ইসলামী বলে জাহির করে বটে, কিন্তু তাদের প্রবল আগ্রহটি নিজেদের দল বাঁচানো নিয়ে। তারা আল্লাহ তায়ালার এজেন্ডাকে বিজয়ী করা নিয়ে ভাবে না। এভাবে মহান আল্লাহ তায়ালাকে খুশি করার বদলে তারা খুশি ও বিজয়ী করে শয়তানের খলিফাদেরকে।

 

 

অনৈক্যে বিপর্যয় অনিবার্য

অনৈক্যের কারণে বিপর্যয় যে অনিবার্য -সে হুশিয়ারীটি পবিত্র কুর‌’আনে এসেছে মহান আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে। বাংলাদেশের ইতিহাসে সে প্রমাণ প্রচুর। কিন্তু এরপরও বিভক্তিতে ইসলামপন্থীদের মাঝে প্রকট আসক্তি।  ১৯৭৫ সালে মুজিবের পতনের পর নিজামে ইসলামীর আমির মাওলানা সিদ্দিক আহমেদের নেতৃত্বে নিজামে ইসলামী, জামায়াতে ইসলামী ও মুসলিম লীগসহ ইসলামপন্থীদের মাঝে  ইসলামী ডিমোক্রাটিক লীগ (IDL) নামে একতার যে প্রচেষ্টা হয়েছিল -সেটিই বাঙালি মুসলিমের ইতিহাসে ছিল একটি বড় মাপের নেক আমল। এর আগে সেরূপ নেক আমল পূর্বে দেখা যায়নি। একাত্তরের পর জেলে থাকা অবস্থায় পাকিস্তানপন্থী এসব দলের নেতাগণ ওয়াদা করেছিলেন যে জেল থেকে মুক্তি পলে তারা রাজনীতির ময়দানে একতাবদ্ধ গড়বেন।  ইসলামী ডিমোক্রাটিক লীগ ছিল তারই ফসল।  কিন্তু সে নেক আমল সুফল দিতে ব্যর্থ হয়েছিল কিছু নেতার মাঝে  নিজেদের দল বাঁচনোর গরজটি প্রবল থাকতে। অনৈক্যের প্রতিটি প্রচেষ্টাই কবিরা গুনাহ। এটি ফিতনা যা মানব হত্যার চেয়েও গুরুতর। তাছাড়া জেলে বসে একতাবদ্ধ থাকার যে ওয়াদা করেছিলেন সে ওয়াদার সাথে তারা গাদ্দারী করেছেন। এটিও ছিল আরেক কবিরা গুনাহ। তবে যারা সে কবিরা গুনাহতে লিপ্ত হয়েছিল তাদের খেসারতও দিতে হয়েছে।

সেদিন ইসলামপন্থীদের মাঝে একতা বাঁচলে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ কোন কালেই ক্ষমতায় ফিরে আসতে পারতো না। জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের ফাঁসিতেও চড়তে হতো না। হিফাজতে ইসলামীর নেতাকর্মীদেরও শাপলা চত্বরে গণহত্যার শিকার হতে হতো না। একাত্তরের ভূমিকা নিয়ে জামায়াতকে  আজ যেরূপ একাকী প্রশ্নের মুখে পড়ছে -সেটিও হতো। বরং একাত্তরের ভূমিকা আজ তাদের জন্য রাজনৈতিক সঠিক সিদ্ধান্তের দলিল হতে পারতো। কারণ তারা একাত্তরে যা বলেছিল -তা শত ভাগ সত্য প্রমাণিত হয়েছে।  মিশরে প্রেসিডেন্ট ড. মহম্মদ মুরসীর বিরুদ্ধে জেনারেল আব্দুল ফাতাহ সিসির ষড়যন্ত্র সফল হওয়ার মূল কারণ, মিশরের ইসলামপন্থীদের মধ্যে অনৈক্য।  ড. মহম্মদ মুরসীর নির্বাচনি বিজয়ের ইসলামপন্থীদের সর্ববৃহৎ দল ইখওযানুল মুসলিমিন আরব বসন্তের বিজয়ের সব ফসল নিজ ঘরে তুলতে চেয়েছিল। ফলে অন্যরা জেনারেল সিসির সাথে যোগ দেয়। ফলে  আরব বসন্তের সকল অর্জন ব্যর্থ হয়ে যায়। তাই ঐক্য অতি গুরুত্বপূর্ণ। ঐক্য বিজয় ও নানা বিধ নিয়ামত আনে; আর অনৈক্য প্রতিশ্রুত আযাব বয়ে আনে।

 

জিহাদে অনাগ্রহ: মুসলিম উম্মাহ নতুন সংকট

বাংলাদেশে বিজয়টি শয়তানের খলিফাদের। ফলে দেশের সংবিধানের আল্লাহর সার্বভৌমত্বের স্বীকৃতি নাই। আদালতে শরিয়তী আইন নাই। শিক্ষাব্যবস্থায় কুর’আন শিক্ষা নাই। দুর্বৃত্তির নির্মূল ও সুবিচার প্রতিষ্ঠায় সরকারের কোন উদ্যোগ নাই। অথচ দেশটি ইসলামের নামে বহু দল এবং তাদের লক্ষ লক্ষ ক্যাডার। কিন্তু মহান আল্লাহতায়ার দ্বীনকে বিজয়ী করার লক্ষ্যে তাদের মাঝে কোন জিহাদ নাই। জিহাদের জন্য মুখলেছ সৈনিকও নাই। কারণ দলীয় ক্যাডারদের মূল তাড়নাটি হয় দলের নেতা, মাজহাবের গুরু ও পীরদের খুশি করা, মহান আল্লাহ তায়ালাকে খুশি করা নয়। অথচ এ দেশটিতে যদি বহু হাজার রাসূল একত্রে প্রেরিত হতেন তবে তাদের মধ্যে সীসাঢালা প্রাচীরসম একতা স্থাপিত হতো। সেরূপ একতা গড়তে তাদেরকে কোন দল গড়তে হতে না। কারণ জিহাদের আযাদে যোগ দিতে দল লাগবে কেন? তাদের সবারই লক্ষ্য হতো মহান আল্লাহ তায়ালাকে খুশি করা; কোন দল, ফেরকা, মজহাব বা ফেরকার প্রধানকে খুশি করা নয়।

আযান শুনে নামাজের জামাতে যেমন নানা ভাষা, নানা বর্ণ ও নানা অঞ্চলের মানুষ ছুটে আসে, সেখানে কোন দল লাগে না। তেমনি জিহাদের আযান শুনে সকল মুসলিমগণ একত্র ছুটে আসবে -সেটিই তো কাঙ্খিত। ইসলামের গৌরব কালে তো সেটিই দেখা গেছে।  আধুনিক কালে তেমনটি দেখা গেছে সোভিয়েত রাশিয়ার বিরুদ্ধে আফগানিস্তানের জিহাদে। সেটি দেখা গেছে সিরিয়ার জিহাদেও। সে জিহাদে যোগ দিতে যেসব হাজার হাজার যুবক ইউরোপ, আলজিরিয়া, ফিলিস্তিন, জর্দান, মিশর, কুযেত, ইয়েমেন, চেচেনিয়া, সৌদি আরব, ইত্যাদি নানা দেশ থেকে নিজ নিজ পেশা ছেড়ে ছুটে এসেছিল তারা কোন দলের  ক্যাডার ছিল না, তাঁরা সবাই ছিল আল্লাহর সৈনিক। তাঁরা ছুটে এসেছিল মহান আল্লাহ তায়ালাকে খুশি করার তাড়নায়।  

কিন্তু সেটি সম্ভব হয়নি  নানা দল, নানা জামায়াত, নানা ফেরকার বাঁধনে আটকা পড়া মুসলিমদের পক্ষে। তাই আফগানিস্তানের জিহাদে প্রতিবেশী পাকিস্তানীদের সেরূপ দেখা যায়নি। কারণ পাকিস্তানের ইসলামপন্থীদের গলায় ছিল নানা সংগঠনের শিকল। জাতীয়তাবাদ ও গোত্রবাদের ন্যায় দলীয়বাদও মানুষের  গলায় শিকল পড়িয়ে দেয়। তারা দলের বাইরে ভাবতে পারেনা। তাই তারা আফগানিস্তানের জিহাদকে আপন করে নিতে পারিনি। তাই অতি কাছে থেকেও জিহাদের ময়দানের হাজির হয়নি। তাই মুসলিম বিশ্বে আজ নতুন সংকট। বাংলাদেশের মত মুসলিম দেশগুলিতে ইসলামের নামে বহু দল সৃষ্টি হওয়াতে দলীয় ক্যাডার বাড়ছে ঠিকই, কিন্তু তাতে একতা গড়ে উঠছে না। ফলে কোন জিহাদও সংঘটিত হচ্ছে না। বরং বাড়ছে বিভক্তি ও পরাজয়। আর শয়তান তো সেটিই চায়। মুসলিম উম্মাহর জন্য এটি এক বিশাল সংকট।  ০৫/০৬/২০২৫

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *