আধিপত্য বিস্তারে আগ্রাসী মার্কিন প্রজেক্ট

ফিরোজ মাহবুব কামাল

যুদ্ধ জায়েজ করতে মিথ্যাচার

মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীদের হাতে ইরাক ও আফগানিস্তান যেভাবে অধিকৃত হলো এবং বিধ্বস্ত হলো তাতে কোন বিবেকমান মানুষই শংকিত না হয়ে পারে না। একটি বিবেকহীন, নীতিহীন ও উদ্ধত সামরিক শক্তির হাতে বিশ্বের দূর্বল জাতিসমূহ –বিশেষ করে মুসলিম বিশ্ব যে কতটা জিম্মি, হলো তারই প্রমাণ। যে অভিযোগের উপর ভিত্তি করে ইঙ্গো-মার্কিন বাহিনী ইরাকের উপর বৃষ্টির ন্যায় বোমা ফেললো, হাজার হাজার মানুষকে হত্যা করলো এবং ধ্বংস করলো অগণিত ঘরবাড়ী, কলাকারখানা ও অফিস আদালত সেটি যে মিথ্যা এবং সেটি যে বলা হয়েছিল নিছক রাজনৈতিক প্রয়োজনে -তা নিয়ে এখন খোদ মার্কিন মহলেও সন্দেহ নেই। প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশের আমলের মার্কিন প্রতিরক্ষা মন্ত্রী মি. রামস্ ফিল্ড স্বীকার করেছিলেন, “ইরাকে তারা সে বহু কথিত ’উয়েপন্স অব ম্যাস ডিসট্রাকশন’ বা ব্যাপক বিধ্বংসী অস্ত্র পাবে না।” সে আমলের মার্কিন প্রশাসনের আরেক কর্তা ব্যক্তি ঊলফোভিচ বলেছিলেন, “ইরাকের বিরুদ্ধে তারা যে “উইপন্স অব ম্যাস ডিসট্রাকশন”য়ের যে অভিয়োগ এনেছিল সেটি ছিল নিছক সরকারি আমলাদের আবিস্কার। এটির লক্ষ্য ছিল বিশ্ব-জনমতকে পক্ষে রাখা। এদিকে বৃটিশ গুপ্তচর বিভাগের এক পদস্থ অফিসারের বরাত দিয়ে পত্রিকায় খবর ছাপা হয়েছে, এ যুদ্ধকে জায়েজ করতে তৎকালিন  ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী মি. টনি ব্লেয়ারের সরকার তাদের উপর ইরাকে “উয়েপন্স অব ম্যাস ডিসট্রাকশন” আছে এর পক্ষে বানায়োট রিপোর্ট তৈরী করতে চাপ দিয়েছিল।

সময় যতই যাচ্ছে, ততই ইঙ্গো-মার্কিনী সাম্রাজ্যবাদী চক্রের থলির বেড়াল বেড়িয়ে আসছে। তারা যে কতটা ভন্ড, কতটা মিথ্যাবাজ এবং কতটা ষড়যন্ত্রকারি সেটিই এখন প্রকাশ পাচ্ছে। অথচ তারা বিশ্ববাসীকে বুঝিয়েছিল, সাদ্দাম মিথ্যাবাদী এবং বিশ্ব-নিরাপত্তার জন্য হুমকি। অপর দিকে সাদ্দাম হোসেন বলেছিল, ইরাকে “উয়েপন্স অব ম্যাস ডিসট্রাকশন” নেই। সেটি প্রমাণিত করার জন্য জাতিসংঘ অস্ত্রপরিদর্শকদেরকে যে কোন স্থানে পরিদর্শণের সুযোগও দিয়েছিল। সাদ্দাম যে এ বিষয়ে মিথ্যা বলেনি সেটিই এখন প্রমাণিত হচ্ছে। অথচ ইরাকে অস্ত্র আছে বলে বুশ ও ব্লেয়ার কসম খেয়েছিল। তাদের এ মিথ্যাচার বিশ্ববাসী যে শুরু থেকেই টের পায়নি তা নয়। টের পেয়েছিল বলেই বিশ্বের নানা শহরে লাখো লাখো মানুষ যুদ্ধ-বিরোধী সমাবেশ করেছে। বলেছে, এ যুদ্ধ ইরাকের সম্পদ লুটের যুদ্ধ। বলেছে, এটি একটি দেশকে পরাধীন করার যুদ্ধ। অবশেষে বিশ্ববাসী যা ভেবেছিল তাই হলো। প্রমাণিত হলো, সর্বার্থেই এ যুদ্ধের নায়কেরা মিথ্যাচারি। এটি অতি নাজায়েজ যুদ্ধ। ফলে এ যুদ্ধে ইঙ্গো-মার্কিন বাহিনী সামরিক ভাবে জিতলেও হেরেছে নৈতিক দিক দিয়ে। নতুন ভাবে প্রকাশ পেয়েছে তাদের আসল চরিত্র। চক্ষুলজ্জা থাকলে জর্জ বুশ ও টনি ব্লেয়ার এ অবস্থায় জনসম্মুখে মুখ দেখাতে শরম পেত। কিন্তু সমস্যা হলো, যে কোন সন্ত্রাসীর ন্যায় রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের এ নায়কদেরও লজ্জাশরম নেই। ফলে অবিরাম মিথ্যা বলছে এখনও। এত বড় জঘন্য রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের পরও তারা বলছে, ইরাকের উপর এমন ধ্বংসজ্ঞ নাকি বিশ্বশান্তির জন্য অপরিহার্য ছিল। সে ধ্বংসজ্ঞ তাদের কাছে উৎসবে পরিণত হয়েছে। কথা হলো, এ মিথ্যাচারি অপরাধীদের কি শাস্তি হবে না? এভাবে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসে বিশ্বনিরাপত্তা বিঘ্নিত করার অপরাধে যদি শাস্তি নয় তবে অন্য সন্ত্রাসের নিন্দার বৈধতা থাকে কি?

 

 রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস ও স্বাধীনতার লড়াই

আফগানিস্তান ও ইরাকে ইঙ্গো-মার্কিনগণ যা করেছে -সেটি নিরেটে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস। সমগ্র মানব ইতিহাসের সকল সন্ত্রাসী মিলে যত হত্যাকান্ড ঘটিয়েছে তার চেয়ে বেশী হত্যাকান্ড ঘটিয়েছে ইঙ্গো-মার্কিন এ রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসী চক্র এ দেশ দুটিতে। এ রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের মোকাবেলায় ইরাকের জনগণ নেমেছে স্বাধীনতার যুদ্ধে। রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসকে জায়েজ করতে আগ্রাসী শক্তি লাগাতর মিথ্যাও বললে। বহু মিথ্যার সাথে তাদের আরেক মিথ্যা হলো, ইরাকী জনগণ নাকি “আহসাল সাহলান” বলে তাদের বাহিনীকে অভিনন্দন করছে। এমন ডাহা মিথ্যা বলেছেন বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার। তিনি অধিকৃত ইরাকের বসরা নগরী ঘুরে এসে বলেছেন ইরাকের জনগণের বিপুল সমর্থণের কথা। অথচ সত্য হলো, তিনি বিক্ষুব্ধ ইরাকী জনগণের সাথে মিশবার সাহসই পাননি। দেখা করেছেন বসরার বৃটিশ সৈনিকদের সাথে। ফলে যা বলেছেন, সেটি নিতান্তই তাঁর কল্পনা প্রসূত। সেটি বলেছেন সরকার পরিচালিত প্রপাগান্ডার অংশরূপে। এরূপ মিথ্যা প্রচারের কাজটি তিনি যুদ্ধের পূর্ব থেকে অবিরাম ভাবেই করে আসছেন। প্রকৃত সত্য হলো ইরাকী জনগণের আক্রোশের ভয়ে তাদের সৈনিকেরা সেনা ছাউনি, সাঁজায়ো গাড়ি ও ট্যংকের বাইরে আসতেও ভয় পায়।

বনের হিংস্র জন্তুজানোয়ার যেমন হামলার ভয়ে জনপদে ঢুকতে ভয় পায় -তেমনি অবস্থা এ ইঙ্গো-মার্কিনী সৈনিকদেরও। অন্যরা বিশদ না জানলেও তারা সঠিক ভাবে জানে নিজেদের কৃত অপরাধের খবর। তারা যে হামলাকারি, তাদের লক্ষ্য যে ইরাক দখল ও দস্যুবৃত্তি –সেটি তারা নিজেরাও জানে। ইরাকের জনগণের জন্য সেখানে তারা ফুলের তোড়া নিয়ে হাজির হয়নি, হাজির হয়েছে হাজার হাজার টন ডিপ্লিটেড ইউরোনিয়াম বোমা, ক্লাস্টার বোমা, আগুণে বোমা ও শত শত ক্রুজ মিজাইল নিয়ে। সে নৃশংস বর্বর হত্যাযজ্ঞার কথা ইরাকী জনগণ কি ভূলতে পারে? এ জন্যই তাদের বিরুদ্ধে প্রচন্ড গণরোষ। তাদের বিরুদ্ধে নানা স্থানে হামলাও হচ্ছে। যতই দিন যাচ্ছে, ততই বাড়ছে হামলার সংখ্যা। আগ্রাসী এ যুদ্ধ লড়তে মার্কিনীরা এসেছে অন্য গোলার্ধ থেকে। তাদের এ রক্তাত্ব আগ্রাসনকে ন্যায্য বললে ইরাকীদের প্রতিরোধের যুদ্ধ বলার যুক্তি থাকে না। ফলে মিথ্যার আশ্রয় নিয়েছে এবং একটি ন্যায্য প্রতিরোধ যুদ্ধকে সন্ত্রাস বলছে। কথা হলো, এমন একটি প্রতিরোধ যুদ্ধকে সন্তাস বললে স্বাধীনতার লড়াই কাকে বলা যাবে? অতীতে স্বাধীনতাকামী ভিয়েতনামীদেরও তারা সন্ত্রাসী বলেছিল। কিন্তু তাতে মার্কিন দখলদারি  দীর্ঘায়ীত হয়নি। বরং বেড়েছে লাশের সংখ্যা। অবস্থা দৃষ্টে মনে হচ্ছে ইরাক দ্রুত তেমন একটি রক্তাত্ব অবস্থার দিকেই ধাবিত হচ্ছে।

 

হিসাবে ভূল

শুরু থেকেই মার্কিনীরা হিসাবে ভূল করেছে। অতিশয় বাতিকগ্রস্ত হলে যা হয়ে থাকে। ভেবেছিল, দু’টি পারমানবিক বোমায় দুই লাখেরও বেশী লোক নিহত হওয়ার পরও জাপানীরা যেভাবে মার্কিন বাহিনীর উপস্থিতি মেনে নিয়েছে তেমনটি ইরাকেও হবে। এতো হত্যা, এতো ধ্বংসযজ্ঞের পর ইরাকের মাটিতে আহলান-সাহলান ও মোবারকবাদ পাওয়ার যে স্বপ্ন প্রেসিডেন্ট বুশ ও প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার দেখেছিলেন সেটি ছিল বস্তুত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-কালীন মানসিকতারই ফসল। কিন্তু তারা ভূলে গিয়েছিল ইরাক জাপান নয়। জার্মানও নয়। জাপান ও জার্মান এ দুটি দেশই ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বহু জঘন্য অপরাধের নায়ক। বিভিন্ন দেশের লক্ষ লক্ষ মানুষকে বড় নৃশংস ভাবে তারা হত্যা করেছিল। দখল করেছিল বহু দেশ। ফলে তারা ছিল মানব-ইতিহাসের অতি বর্বর যুদ্ধ অপরাধী। আর অপরাধীদের যে শাস্তিই দেয়া হোক না কেন তা মাথা পেতে মেনে নেওয়ার ছাড়া গত্যন্তর থাকে না। এমন অপরাধিরা প্রতিরোধ ছেড়ে আত্মগোপন করে। তখন বিজয়ী শক্তির দেওয়া শাস্তিকে তারা ন্যায্য পাওনা ভাবে। ফলে এমন অপরাধী জাতি পরাজিত হলে তাদের মধ্যে জন্ম নেয় না প্রতিরোধের নৈতিক বল। তাই ভিয়েতনামে বা আফগানিস্তানের ন্যায় দুর্বল দেশে দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিরোধ গড়ে উঠলেও জাপানে বা জার্মানীতে তা হয়নি।

অপরদিকে ইরাকী জনগণ যুদ্ধাপরাধি নয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা বৃটেনের বিরুদ্ধে এদেশটির জনগণ কোন অপরাধই করেনি। ফলে তারা কেন মার্কিন আধিপত্যকে মেনে নিবে? তাছাড়া সাদ্দাম স্বৈরাচারি হলেও সে অপরাধ নিছক সাদ্দামের। এজন্য জনগণ কেন ইঙ্গো-মাকিনীদের সাম্রাজ্যবাদী শাসনকে মেনে নিবে? ফলে সাদ্দামের বাহিনী পরাজিত হলেও বিপুল আম-জনতা “মার্কিনীরা ইরাক ছাড়” দাবীতে রাস্তায় নেমেছে। ইঙ্গো-মার্কিন বাহিনী তাই বুঝতে পেরেছে জনগণ কতটা আক্রোশপূর্ণ। প্রতিবাদপূর্ণ এ আক্রমনই তাদেরকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে তারা ইরাকের বন্ধু নয়, তারা অপরাধী। আর সে অপরাধ-চেতনাই তাদের অবচেতন মনে সদাসর্বদা কাজ করছে। ফলে বোরখা পরিহিত নারী, মিছিলকারি নিরস্ত্র ছাত্র বা টুপি-পরিহিত নিরস্ত্র পথচারিও তাদের কাছে সশস্ত্র শত্রু মনে হয়।

ভীতসন্ত্রস্ত ও হত্যাপাগল মার্কিন চেতনার প্রকাশ ঘটেছে বাগদাদের উত্তরে একটি ছোট্ট শহরে। মার্কিন বাহিনী সেখানে ঘাঁটি গেড়ে বসেছে শহরের স্কুলটিতে। লেখাপড়া বন্ধ হওয়ায় বিক্ষুব্ধ হয়েছে স্কুলের ছাত্রা। স্কুল জবরদখলের বিরুদ্ধে তারা নিরস্ত্র মিছিল করেছিল। আর তাতেই আতংকিত হয় মার্কিন বাহিনী গুলী চালিয়ে হত্যা করেছে তিরিশ জনেরও বেশী স্কুল ছাত্রকে। একই রূপ ভীতি নিয়ে হত্যা করছে বহু পথচারিকেও। যে দখলদার বাহিনী নিরস্ত্র জনগণকে এভাবে শত্র“জ্ঞান করে তারা কি জনগণের বন্ধু হতে পারে? তারা কি পারে জনগণের সাথে জনগণের কল্যাণে কাজ করতে?  তারা যে পারছে না তার বড় প্রমাণ, ইঙ্গো-মার্কিন বাহিনী এ অবধি কোন প্রশাসনই গড়ে তুলতে পারিনি। তারা সাধারণ ইরাকীদের কাছে এতটাই কুৎসিত অপরাধিরূপে চিত্রিত হয়েছে যে কোন সম্মানী ব্যক্তি তাদের কাছে ভিড়তেই ঘৃণা করে। এমন কি এতকাল যারা মার্কিনীদের সহায়তা দিয়েছে তারাও এখন সহযোগিতায় শরম পাচ্ছে। ফলে গার্নার নামের যে অবসরপ্রাপ্ত জেনারেলটি প্রশাসনের দায়িত্ব নিয়ে প্রেসিডেন্ট বুশ ইরাকে পাঠিয়েছিল তার সকল চেষ্টাই ব্যর্থ হয়েছে। এখন এসেছে মিস্টার পল ব্রেমার। সেও এগুতে পারছে না। গড়বে কি?  এখনও ভাঙ্গতেই ব্যস্ত। ব্রেমের এসেই ইরাকের ৪ লাখের বিশাল সেনাবাহিনীকে  বিলুপ্ত করেছে। বিলুপ্ত করেছে আদালত, নিরাপত্তা পুলিশ ও তথ্যমন্ত্রালয়। ফলে চাকুরি হারিয়েছে লক্ষ লক্ষ ইরাকী। তারা এখন সমাজের সবচেয়ে বিক্ষুব্ধ মানুষদের কাতারে। বসরা শহরের পৌর প্রশাসনের দায়িত্ব থেকে ইরাকীদের হঠিয়ে ব্রিটিশ সেনা অফিসার নেওয়ায় সেখানে হাজার হাজার মানুষের প্রতিবাদ মিছিল হয়েছে। কিন্তু দখলদার বাহিনীর সেদিকে ভ্রুক্ষেপও নাই। ফলে বাড়ছে ক্রোধ। অথচ ইঙ্গো-মার্কিনী দখল বাহিনী বলেছিল, তারা ইরাকের জনগণের অধিকার ফিরিয়ে দিবে, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করবে। কথা হলো, এটিই কি ইঙ্গো-মার্কিনী গণতন্ত্র গণতন্ত্রের নমুনা?

যতই বাড়ছে ইরাকীদের প্রতিরোধ ততই বাড়ছে ইরাকের প্রতিবেশীদের বিরুদ্ধে মার্কিনীদের আক্রোশ। এ প্রতিরোধকে বলছে প্রতিবেশী সিরিয়ার সৃষ্টি। সিরিয়ার বিরুদ্ধে মার্কিন প্রশাসন ইতিমধ্যে চরম হুশিয়ারিও দিয়েছে। তাদেরকে বলেছে ইরাকের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করতে। কথা হলো প্রতিবেশী দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে নসিহত দান কি মার্কিনীদের সাজে? তারা শুধু হস্তক্ষেপ করতে নয় বরং একটি অতিশয় বিধ্বংসী যুদ্ধ চাপাতে হাজার হাজার মাইল দূর থেকে ছুটে এসেছে। ফলে হস্তক্ষেপের এ কাজ যদি ইঙ্গো-মার্কিনীদের কাছে জায়েজ হয়, তবে তা ইরাকের নিকটতম প্রতিবেশীদের কাছে নাজায়েজ হবে কেন? এটি কি এজন্য যে সামরিক দিক দিয়ে তারা দূর্বল?  আইন মার্কিনীদের জন্য একটি আর অন্যদের জন্য আরেকটি সেটি কি নৈতিকতা? এটি কি বর্ণবাদের কুৎসিত রূপ নয়? দক্ষিণ আফ্রিাকার শ্বেতাঙ্গ বর্ণবাদীরা তো এমন বর্ণবাদী আইনই প্রতিষ্ঠা করেছিল। ইঙ্গো-মার্কিনারা কি সেটিই বিশ্বময় করতে চায়? সেটি যে চায় তার প্রমাণ বহু।

 

ঔপনিবেশিক শাসনের নতুন মডেল

মার্কিনীগণ যে কতটা উদ্ধত ও হত্যাপাগল সেটি বুঝাা যায় কাবুলের মার্কিন দূতাবাসের সামনে ৫ জন আফগানীকে গুলী করে হত্যা। যে কোন দেশের অভ্যন্তরে সে দেশের নাগরিক হত্যার অধিকার কোন বিদেশীর থাকে না। এটি সার্বভৌমত্বের প্রশ্ন। এমন হত্যার অপরাধে তাকে সে দেশের কারাগারে ঊঠতে হয়। কিন্তু মার্কিনীদের আদালতে যেতে হয়নি। বরং এমন হত্যাকান্ড চালানোর মূক্ত অধিকার চায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এটি নিরেট ঔপনিবেশিক মানসিকতা। এ মানসিকতা নিয়েই বিদেশী বৃটিশ ভারতে পক্ষি শিকারের স্বদেশী শিকার করেছে। মার্কিনীরা সে অধিকার চায় বিশ্বব্যাপী। তাদের গায়ে গূলী দূরে থাক ঢিলও ছুঁড়েনি -এমন বহু মানুষকে মার্কিন নিজ দেশের জেলে বা গুয়ান্তানামোর কারাগারে নিয়ে গেছে। অথচ তারা নির্বিচারে গণহত্যা চালালেও কোন আদালতে বিচারের মুখোমুখি করা যাবে না। মার্কিনীরা এমন বিচারের অধিকার দেয়নি এমনকি আন্তর্জাতিক ক্রিমিনাল কোর্টকে। এক কালে ভিয়েতনামে যেটি করেছে সেটিই আজ আফগানিস্তান ও ইরাকে করছে। সে বর্ণবাদী মার্কিন আধিপত্য প্রতিষ্টা দিতেই আফগানিস্তানে মেরুদন্ডহীন কারজাইকে ক্ষমতায় বসিয়েছে। ফলে আফগান নাগরিকদের বাঁচানো নিয়ে এ বিবেকহীন দাসটির সামান্যতম মাথা ব্যাথা নেই। তার সকল মাথা ব্যাথা আফগানিস্তানে মার্কিনীদের কি করে সর্বাধিক নিরাপত্তা দেওয়া যায় তা নিয়ে।

বৃটিশেরা একই রূপ ঔপনিবেশবাদ প্রতিষ্ঠা করেছিল ভারতে। তবে পার্থক্য হলো, সে কালে বৃটিশ স্বার্থের পাহারিদারি করতে ইংল্যান্ড থেকে বিশ্বাসভাজন লোককে বড়লাট বা গভর্নর জেনারেল করে পাঠানো হতো। কিন্তু এখন বিশ্বস্থ ও পরীক্ষিত গোলামদের বসানো হচ্ছে অধিকৃত দেশগুলী থেকেই। আর এ গোলামদের পাহারাদারির জন্য এসব অধিকৃত দেশে ঘাঁটি গেড়ে বসেছে মার্কিন বাহিনী। ঔপনিবেশবাদের এটিই হলো নয়া মডেল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ঔপনিবেশিক শক্তিবর্গ আফ্রো-এশিয়ার দেশগুলো থেকে বাহ্যিক ভাবে বিতাড়িত হলেও হাজির হয়েছে এ নতুন মডেল নিয়ে। আর এ নয়া মডেলের পরীক্ষা নিরীক্ষা প্রথমে শুরু হয় তেল সমৃদ্ধ মুসলিম মধ্যপ্রাচ্যে। কাতার, কুয়েত, সৌদি আরব, বাহরাইন, ওমান, আমিরাত বা জর্দান হলো এমন ঔপনিবেশবাদের শিকার। উসমানিয়া খেফাফত টুকরো টুকরো করে প্রতিষ্ঠিত হয় এ দেশগুলি। শাসন ক্ষমতায় বসানো হয় অতিশয় অনুগত দাসদের। ফলে বৃটিশ ও মার্কিন সেনাবাহিনী এসব দেশগুলোতে যত্রতত্র ততটাই স্বাধীনভাবে যেতে পারে যতটা ইংরেজ বাহিনী পারতো ১৯৪৭-পূর্ব ভারতে। এসব দেশে অন্য কোন মুসলিম দেশের পণ্য মূক্ত প্রবেশাধিকার না পেলে কি হবে বৃটিশ বা মার্কিন পণ্য স্বাধীনভাবে বাজার দখল করছে। যেমন ঔপনিবেশিক আমলে ভারতের বাজার দখল করেছিল বৃটিশ পণ্য। একই ভাবে এসব দেশ থেকে শত শত বিলিয়ন ডলারের বিশাল বাড়তি পুঁজি গিয়ে উঠছে মার্কিন ও বৃটিশ ব্যাংকগুলোতে। শোষন-শাসনের এ মডেলটি এতটাই সফল হয়েছে যে এখন তারা এর সম্প্রসারণ চায় বিশ্বের অন্যান্য দেশগুলোতেও। আর এটিই হলো একবিংশ শতাব্দির বিশ্বকরায়ত্বের মার্কিনী প্রজেক্ট।

আফগানিস্তান অধিকৃত হলো, অধিকৃত হলো ইরাক, এবং পাকিস্তান, উযবেকিস্তান, তাজাকিস্তান ও সৌদি আরবসহ বহু মুসলিম দেশে মার্কিন ঘাঁটিও নির্মিত হলো – এসবই হলো সে মার্কিন প্রজেক্টের অংশরূপে। ফলে ইরাকের উপর ইঙ্গো-মার্কিন যুদ্ধটি স্রেফ সাদ্দামের বিরুদ্ধে ছিল না, ছিল না “উইপন্স অব ম্যাস ডিসট্রাকশন”য়ের কারণে। সম্প্রতি মার্কিন কর্মকর্তাদের ঘোষণায়ও সেটিই প্রমাণিত হয়েছে। এটির লক্ষ্য ছিল বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম তেলসমৃদ্ধ দেশে উপনিবেশবাদী মার্কিন শাসনের বিস্তার। অপরদিকে ইরাকের বিরুদ্ধে এ য্দ্ধুটি সাম্রাজ্যবাদীদের পরিচালিত প্রথম যুদ্ধ যেমন নয়, তেমিনি শেষ যুদ্ধও নয়। তাঁদের ক্ষুধা সীমাহীন। এ সীমাহীন ক্ষুধাই অতীতে ক্ষুদ্র বৃটিশ জাতিকে বিশ্বব্যাপী সাম্রাজ্য বিস্তারে আগ্রহী করেছিল। মার্কিনীদের সামর্থ্য এক্ষেত্রে বৃটিশের চেয়ে বহু গুণ অধিক। ফলে বিপদ শুধু ইরাক বা আফগানিস্তানের নয়। কোরিয়া, ইরান বা সিরিয়ারও নয়। এ বিপদ বিশ্বের সকল স্বাধীনচেতা জাতি সমুহের। বিশ্বের দুর্বল জাতিসমূহের শংকার মূল কারণ এখানেই। তাই এনিয়ে প্রতিটি বিবেকমান মানুষের যেমন ভাববার আছে, তেমনি কিছু করবারও আছে। নইলের সুনামীর মত ধেয়ে আসবে সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন। ০১/০৬/২০০৩।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *