অধ্যায় সাতাশ: শেখ মুজিবের ষড়যন্ত্রের রাজনীতি

ষড়যন্ত্র শুরু থেকেই

১৯৪৭ সালে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার পর থেকেই পাকিস্তানে প্রচুর সমস্যা ছিল। ভৌগলিকভাবে দুটি প্রদেশের মাঝে হাজার মাইলের বেশী ব্যবধান থাকায় সে সমস্যায় জটিলতাও ছিল।পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে প্রচুর বৈষম্যও ছিল। সে বৈষম্যের শুরু ১৯৪৭ সাল থেকে নয়, দেশটির জন্মের শত বছরপূর্ব থেকেই। দিল্লির মোগল শাসনের পতন হয় ১৮৫৭ সালে, আর বাংলায় মুসলিম শাসনের বিলুপ্তি ঘটে শত বছর আগে ১৭৫৭ সালে। ফলে বাঙালীর মুসলিম জীবনে ঔপনিবেশিক ব্রিটিশদের অর্থনৈতিক রক্তশূন্যতা সৃষ্টির কাজটি শুরু হয় পশ্চিম পাকিস্তানীদের জীবনে শুরু হওয়ার এক শত বছর আগে। ব্রিটিশগণ বাংলার মসলিন শিল্পিদের যেভাবে আঙ্গুল কেটেছে সে নিষ্ঠুর কাজটি পাঞ্জাব, সিন্ধু, বেলুচিস্তান বা পাখতুন খা’ প্রদেশে করেনি। পশ্চিম পাক্স্তিানভূক্ত এলাকায় কৃষকদের নীল চাষেও বাধ্য করেনি। লাহোরে পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা হয় ১৮৮২ সালে;দিল্লির পতনের মাত্র ২৮ বছরপর।অথচ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা হয় ১৯২১ সালে –অর্থাৎ বাংলার উপর ব্রিটিশ অধিকৃতির ১৬৪ বছরপর।ব্রিটিশের গোলামী শুরু হওয়ার পাশাপাশি বাঙালী মুসলিমদের উপর শোষন ও নির্যাতনের আরেকটি নির্মম যাঁতাকল চেপে বসেছিল; সেটি ছিল হিন্দু জমিদার ও মহাজনদের শোষণ প্রক্রিয়া। ব্রিটিশের আশ্রয়ে ও প্রশ্রয়ে বেড়ে উঠা হিন্দু জমিদার ও বাবুশ্রেণীর কাজ ছিল মুসলিমদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক অগ্রগতিকে সর্বতোভাবে দাবিয়ে রাখা।

মুসলিমদের দাবিয়ে রাখার কাজে ব্রিটিশ ও হিন্দু কোয়ালিশন এতোটাই সফল হয়েছিল যে, তৎকালে বাংলার সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ মুসলিম হলে কি হবে শহর এলাকার শতকরা ৮৫ ভাগের বেশী জমিজমার মালিক ছিল হিন্দু। দেশে পাকা দালান-কোঠার শতকরা প্রায় ৯৮ ভাগের মালিক ছিল হিন্দু।অবিভক্ত বাংলার শতকরা প্রায় ৬০ ভাগ মুসলিম হওয়া সত্ত্বেও সরকারি চাকুরিতে বাঙালী মুসলিমের সংখ্যা শতকরা ১০ ভাগও ছিল না।পশ্চিম পাকিস্তানীদের ঘাড়ে গোলামীর এ বাড়তি ও বর্বর দেশী জোয়ালটি ছিল না। ফলে অর্থনৈতিক ও সামাজিক ভাবে তারা এতোটা পশ্চাদপদ ছিল না। পাকিস্তান সৃষ্টির পূর্বমুহুর্তে ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিস (আইসিএস)’এর অফিসার র‌্যাংকে কোন বাঙালী মুসলিম ছিল না।-(Chowdhury, Abdul Mu’min; 2005)। অথচ ব্রিটিশ প্রশাসনে অবাঙালী মুসলিমদের সংখ্যাটি ছিল উল্লেখযোগ্য। ভারতের শেষ ব্রিটিশ ভাইসরয় লর্ড মাউন্ট ব্যাটনের ভাষায় মুসলিম অধ্যুষিত পূর্ব বাংলা ছিল rural slum তথা গ্রাম্য বস্তি। এ যুক্তিটি দেখিয়ে তিনি মুহাম্মদ আলী জিন্নাহকে পশ্চাৎপদ পূর্ব বাংলার দায়ভার পাকিস্তানের ঘাড়ে না নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন। (Mountbatten Papers, 1947)।এভাবে পূর্ব বাংলার ভারতভূক্তির পক্ষে চাপ সৃষ্টি করেছিলেন। সে সময় বাংলার ব্রিটিশ গভর্নর ছিলেন R. G. Casey। তিনিও সোহরাওর্দীসহ বাংলার অন্যান্য মুসলিম লীগ নেতাদের বলেছিলেন, পাকিস্তান পেতে হলে বিভক্ত বাংলাকে মেনে নিতে হবে। বিচ্ছিন্ন পূর্ব বাংলার নাজুক অবস্থার যুক্তি দেখিয়ে তাদেরকে পাকিস্তান প্রকল্প ছেড়ে অখণ্ড ভারতে যোগ দিতে প্ররোচিত করেছিলেন। কিন্তু বাংলার মুসলিম নেতাগণ সে সময় ভারতে যোগ দেয়ার বিপদটি বুঝতে ভূল করেননি। তারা জেনে বুঝেই সেদিন পাকিস্তানের যোগ দিয়েছিলেন। কিন্তু ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টির সাথে সাথে দেশটির দুই অঞ্চলের মাঝে বহুদিনের বিরাজমান বিশাল বৈষম্যটি তৎক্ষনাৎ বাঙালী জাতীয়তাবাদীদের নজরে পড়ে; এবং সেটি ত্বরিৎ রাজনীতির হাতিয়ারে পরিণত হয়। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মাঝে বিরাজমান বৈষম্যের কারণগুলো বুঝা ও সেগুলির সমাধান নিয়ে যতটা চেষ্টা হয়েছে তার চেয়ে সে বৈষম্য বেশী ব্যবহৃত হয়েছে ক্ষমতালিপ্সার রাজনীতিতে হাতিয়ার রূপে। আর যে দেশে এরূপ বৈষম্য থাকে সেদেশে মানুষ ক্ষ্যাপানোর কাজে কি অন্য কিছুর প্রয়োজন পড়ে? সে রাজনৈতিক হাতিয়ারটির ব্যবহারে শেখ মুজিব অতি চাতুর্যের পরিচয় দিয়েছেন। ইসলাম ও মুসলিম উম্মাহর কল্যাণ বা পাকিস্তানের সংহতি নিয়ে মুজিবের কোন চিন্তা ছিল না। তার রাজনীতির মূল লক্ষ্যটি ছিল স্রেফ ক্ষমতা লাভ, এবং সে লক্ষ অর্জনে মূল কৌশলটি ছিল দুই প্রদেশের মাঝে বিদ্যমান এ বৈষম্যকে ব্যবহার করা। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর দুই অঞ্চলের মাঝে বৈষম্য দূরীকরণে যে প্রচেষ্টা শুরু হয়েছিল –তা নিয়ে সন্দেহ নাই; কিন্তু মুজিব ও তার সঙ্গিগণ সময় দিতে রাজী ছিল না।

দেশটির শত্রুরা শুরু থেকেই চায়নি দেশটি প্রতিষ্ঠা পাক। প্রতিষ্ঠার পর চায়নি দেশটি বেঁচে থাক। রাজনীতির অঙ্গণ পূর্ণ হয়েছে নানারূপ দেশী-বিদেশী ষড়যন্ত্রে। ভাষা, বর্ণ, আঞ্চলিক বন্ধনকে যারা রাষ্ট্রগঠনের ভিত্তি মনে করে -তাদের কাছে ১২শত মাইলে দূরত্বে বিচ্ছিন্ন দুটি অঞ্চল নিয়ে পাকিস্তানের সৃষ্টি ছিল প্রচণ্ড বিস্ময়। বাঙলা যে ১৯০ বছর যাবত প্রায় পাঁচ হাজার মাইল দূরের ইংলান্ডের শাসনভূক্ত থাকলো সেটি তাদের কাছে ততটা বিস্ময়কর মনে হয়নি। পাকিস্তান প্রকৃত অর্থেই ছিল একটি আদর্শিক রাষ্ট্র। এ রাষ্ট্রটি ভাষা, বর্ণ ও অঞ্চল-ভিত্তিক বন্ধনের উপর প্রতিষ্ঠা পায়নি। ইসলামের প্রতি অঙ্গীকার ছিল রাষ্ট্রটির জনগণের মাঝে একমাত্র বন্ধন। কিন্তু যারা ইসলামের দুষমন তাদের কাছে পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠা ও বেঁচে থাকাটিই ছিল অসহ্য। তাই শুরু থেকেই পাকিস্তানের শত্রুর অভাব পড়েনি। সেটি যেমন দেশে, তেমনি বিদেশে। শত্রুদের সে কোয়ালিশনই ১৯৭১’য়ে পাকিস্তানের আভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে সশস্ত্র রূপো হাজির হয় এবং দেশটি সামরিক ভাবে পরাস্ত করে এবং দ্বিখণ্ডিত করে। শেখ মুজিব প্রায়ই বলতেন, তাঁর বিরুদ্ধে প্রাসাদ ষড়যন্ত্র হচ্ছে। অথচ শেখ মুজিব নিজেই ষড়যন্ত্র করেছেন পাকিস্তানের অস্তিত্বের বিরুদ্ধে এবং সেটি করেছেন পাকিস্তানের আজন্ম শত্রু ভারতের সাথে মিলে সংগোপনে। শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে আনা আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার অভিযোগগুলি যে শতভাগ সত্য ছিল সেটি প্রকাশ পায় বাংলাদেশ সৃষ্টির পর। যাদের বিরুদ্ধে সে ষড়যন্ত্র মামলায় অভিযোগ আনা হয়েছিল,তারাই একাত্তরের পর সে সংশ্লিষ্টতা নিয়ে বাহাদুরি দেখানো শুরু করে।সে বাহাদুরিটা পাকিস্তান ভাঙ্গা এবং সে সাথে বাংলাদেশ সৃষ্টির সাথে যুক্ত থাকার। অথচ মুজিব এ মামলাকে বলেছেন তার উপর চাপানো ষড়যন্ত্রমূলক মিথ্যা মামলা।

ফলে যারা বলেন, শেখ মুজিব বাংলাদেশ স্বাধীন করার সিদ্ধান্তটি নেন ২৫শে মার্চ পাকিস্তান আর্মির এ্যাকশনের পর -তারা সঠিক বলেন না। তারা সেটি বলেন প্রকৃত বিষয়টি না জেনেই। পাকিস্তান ভাঙ্গার সিদ্ধান্তটি শেখ মুজিব অনেক পূর্বেই নিয়েছিলেন।এবং সে সিদ্ধান্তটি নিয়েছিলেন ভারতের সাথে মিলে। আওয়ামী লীগের প্রথম সারির নেতা এবং সাবেক সাধারণ সম্পাদক জনাব আব্দুর রাজ্জাক সাপ্তাহিক মেঘনায় দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, মুজিব তাদেরকে ভারতের সাথে যোগাযোগ করতে বলেছিলেন।সেখান থেকে সাহায্য মিলবে সে আশ্বাসও দিয়েছেন। মুজিবের ষড়যন্ত্র শুধু পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ছিল না; ছিল বাঙালী মুসলিম এবং সে সাথে সমগ্র মুসলিম উম্মাহর বিরুদ্ধে। কারণ তার ষড়যন্ত্রে শুধু পাকিস্তান দুর্বল হয়নি।পাকিস্তানের চেয়ে বেশী দুর্বল হয়েছে বাংলাদেশ। এবং দুর্বল হয়েছে সমগ্র মুসলিম উম্মাহ। সে সাথে আগামী বহু শত বছরের জন্য ভারতের হিংস্র থাবায় পড়েছে বাংলাদেশের ১৬ কোটি মানুষ। পাকিস্তান ভাঙ্গায় মুজিব ক্ষমতা পেলেও বাংলার জনগণ বিশ্বের সর্ববৃহৎ ও সবচেযে শক্তিশালী মুসলিম রাষ্ট্রের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ রূপে বিশ্বরাজনীতিতে যে প্রভাব ফেলতে পারতো সে সুযোগ ধূলিস্যাৎ হয়ে গেল। ইসলামের বিরুদ্ধে মুজিবের নাশকতা শুধু পাকিস্তান ভাঙ্গার মধ্য দিয়ে শেষ হয়নি; সেটি বরং প্রচণ্ড ভাবে শুরু হয় বাংলাদেশ সৃষ্টির পর। শুরু থেকেই তার রোষানল পড়ে ইসলামপন্থী দলগুলোর প্রতি। সকল জাতের নাস্তিক, কম্যুনিস্ট, সোসালিস্ট, ভারতপন্থী, রুশপন্থী, চীনপন্থীকে রাজনীতির অধিকার দিলেও সে মৌলিক অধিকারটি তিনি কেড়ে নেয়া হয় ইসলামপন্থীদের থেকে।

ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাষ্ট্রগড়ার মহাবিপদটি হলো, এসব রাষ্ট্রের প্রতিরক্ষার সামর্থ থাকে না। কারণ প্রতিরক্ষার খরচটি বিশাল। গ্রেট ব্রিটেন, ফ্রান্স, জার্মানীর ন্যায় ইউরোপীয় দেশগুলো সে খরচের ভয়ে ন্যাটোর জন্ম দিয়েছে। প্রতিরক্ষা-খরচের ভারে সোভিয়েত রাশিয়া বিলুপ্ত হয়ে গেল। বিপুল তেল সম্পদ থাকলেও সে সামর্থ্য সৌদি আরব,কাতার, কুয়েত কোন আরব দেশেরও নাই। তাই ১৯৪৮, ১৯৬৭ এবং ১৯৭৩ সালে ইসরাইলের হাতে তারা লজ্জাজনক ভাবে পরাজিত হয়েছিল। আগ্রাসী প্রতিবেশী দেশ ভারতের বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষার সে সামর্থ বাংলাদেশের আজ যেমন নাই, ১৯৪৭ সালেও ছিল না। আর প্রতিরক্ষার সামর্থ না থাকলে কি স্বাধীনতা থাকে? তেমন দেশ তো দ্রুত কাশ্মীর, হায়দারাবাদ, সিকিম, ভূটানে পরিনত হয়। ১৯৪৭ সালে খাজা নাজিম উদ্দীন, শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মত বাংলার মুসলিম লীগ নেতারাও সেটি বুঝেছিলেন। ফলে পশ্চিম পাকিস্তানীদের সাথে মিলে অখণ্ড পাকিস্তান গড়া ছাড়া তাদের সামনে ভিন্ন পথ ছিল না। তারা সংশোধন এনেছিলেন লাহোর প্রস্তাবে। নইলে বাংলাদেশ অধিকৃত আরেক কাশ্মীরে পরিণত হত ১৯৪৭ সাল থেকেই। পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠা ছিল মুসলিম-সংহতির ইতিহাসে বিরল নজির। বিভক্ত মুসলিম উম্মাহর জন্য এটি ছিল অনুপ্রেরণার উৎস। এরূপ একতা যে মহান আল্লাহতায়ালাকে প্রচণ্ড খুশি করে –সেটি কি অস্বীকার করা যায়?

 

লক্ষ্য অখণ্ড ভারত

ভূমি থাকলে সেখানে ফসল ফলানোর সাধও জাগে। পাকিস্তান ছিল বিশ্বের সর্ববৃহৎ মুসলিম ভূমি। বিশ্বমাঝে গুরুত্বপূর্ণ শক্তি রূপে বেড়ে উঠার জন্য এমন একটি বৃহৎ ভূমি ও বিশাল জনসংখ্যা অপরিহার্য ছিল। কিন্তু ইসলামের শত্রুপক্ষ বিশেষ করে ভারত, ইসরাইল, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, সোভিয়েত রাশিয়াসহ কোন রাষ্ট্রই সে সুযোগ দিতে রাজী ছিল না। রাজী ছিল না ইসলামের ঘরের শত্রুরাও। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা পায় ১৯৪৭ সালের ১৪ই আগষ্ট। ঐ বছরের সেপ্টম্বর মাসে নিখিল ভারত কংগ্রেসের বৈঠক বসেছিল মোম্বাই শহরে। সে বৈঠকে প্রশ্ন উঠেছিল, কংগ্রেস সবসময় অখণ্ড ভারতের কথা জনগণকে বুঝিয়েছে। এখন এ বিভক্ত ভারত নিয়ে কংগ্রেস কর্মীরা কিভাবে জনগণের সামনে মুখ দেখাবে? প্রশ্নকর্তাদের শান্ত করতে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ও কংগ্রেস নেতা জহরলাল নেহেরু বলেছিলেন, “আপাতত এ বিভক্তিকে আমরা মেনে নিচ্ছি।” ভারতীয় পররাষ্ট্র নীতি তথা পাকিস্তানের প্রতি ভারতের শত্রুসুলভ আচরণের মূল রহস্য হলো ভারত বিভাগকে এই আপাতত মেনে নেয়ার বিষয়টি। অর্থাৎ ১৯৪৭ য়ের ভারত বিভক্তি বা পাকিস্তানের সৃষ্টিকে মেনে নেয়ার বিষয়টি ভারতীয় নেতাদের আপততমেনে নেয়ার নীতির মধ্যে সীমিত। এ ভারত-বিভক্তিকে দিল্লির শাসকচক্র কখনোই মন থেকে মেনে নেয়নি; শুধু সুযোগের অপেক্ষায় ছিল কি করে পাকিস্তানকে ভাঙ্গা যায়। আর সে সুযোগটিই একাত্তরে শেখ মুজিব ও তার অনুসারিরা ভারতের হাতে তুলে দেয়। সেটি ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে। আর ষড়যন্ত্রের বিষয়টি তো নির্বাচনে আলোচনা বা ভোটদানের বিষয় নয়, দলীয় নেতাকর্মীদের সভাসমিতির বিষয়ও নয়। ষড়যন্ত্র সব সময়ই কয়েক ব্যক্তির নিজস্ব বিষয়। তাই পাকিস্তান ভাঙ্গার প্রশ্নে মুজিব জনগণ থেকে মেন্ডেট বা ভোট নেয়ার প্রয়োজন বোধ করেননি। নিজ দলের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের একত্রিত করে তাদের মতামত শোনার প্রয়োজনও বোধ করেননি। একজন গোত্র-প্রধানের ন্যায় মুজিব ভেবেছেন তাদের মতামত তার নিজ পকেটে; অর্থাৎ তিনি যা ভাবেন সেটিই আওয়ামী লীগের সবার অভিমত। পরামর্শ যা করার তা করেছেন ভারতীয় গুপ্তচরদের সাথে। তবে একাত্তরে পাকিস্তান ভাঙ্গা ও বাংলাদেশ সৃষ্টির কাজটি সমাধা হলেও অখণ্ড ভারত সৃষ্টির লক্ষ্যটি পূরণ হয়নি। এ লক্ষ্যে ভারত আরো সামনে এগুতে চায়। সে কাজে দুয়েক জন মুজিব যথেষ্ট ছিল না। সে লক্ষ্যে চাই বাংলাদেশের মাটিতে শত শত মুজিব। বাংলাদেশের রাজনীতি, শিক্ষা-সংস্কৃতি ও মিডিয়া জগতে বাঙালী সেক্যুলারিস্ট সরকারের মূল লক্ষ্যটি মূলত ভারতের প্রতি নতজানু বেশী বেশী মুজিব সৃষ্টি। আর সে মুজিবী চেতনার চাষাবাদে বাংলাদেশের শিক্ষা, সংস্কৃতি, রাজনীতি ও মিডিয়ায় ভারতের বিনিয়োগটিও বিশাল। সরকারি প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি সেখানে কাজ করছে শত শত বেসরকারি প্রতিষ্ঠানও।

মুসলিমের বাঁচা-মরার যেমন লক্ষ্য থাকে, তেমনি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য থাকে রাজনীতিরও। বাঁচা-মরার সে মূল লক্ষ্যটি হলো, প্রতিকর্মের মধ্য দিয়ে মহান রাব্বুল আ’লামীনকে খুশি করা। সে বাঁচে এবং মৃত্যু বরণ করে একমাত্র মহান আল্লাহতায়ালার জন্য। তার রাজনীতিতে সে লক্ষ্যটি হলো, ইসলামকে সর্বস্তরে বিজয়ী করা। মহান আল্লাহতায়ালার মহান ভিশনই হলো মু’মিন ব্যক্তির ভিশন। সেটি নানা ধর্ম ও নানা মতাদর্শের উপর আল্লাহতায়ালার নিজ দ্বীনের বিজয় -যা বর্নিত হয়েছে সুরা সাফ, তাওবা ও ফাতহে। দ্বীনের সে বিজয়ের মাঝেই মুসলিমদের পার্থিব ও আখেরাতের কল্যাণ। ফলে মুসলিমের ধর্মকর্ম ও বাঁচার মধ্যে যেমন সিরাতুল মোস্তাকিম থাকে, সেটি থাকে তার রাজনীতিতেও। অথচ মুজিবের সেক্যুলার রাজনীতিতে সেটি ছিল না। তাই তাঁর রাজনীতিতে ইসলামের প্রতি সামান্যতম অঙ্গীকারও ছিল না। বরং ছিল যে কোন উপায়ে ক্ষমতা দখলের নেশা। সে নেশা পূরণে ভারতীয় সরকার ও সে দেশের গুপ্তচরদের সাথে নিয়ে কাজ করতেও তার আপত্তি ছিল না। ক্ষমতা দখলের সে নেশা পূরণ করতেই একাত্তরে একটি রক্তাক্ষয়ী যুদ্ধকে শেখ মুজিব অনিবার্য করে তুলেন। ব্যক্তিস্বার্থ পূরণের এমন রাজনীতি এবং ইসলামের প্রতি এমন অঙ্গীকারহীনতায় কি মুসলিমের কল্যাণ হয়? এরূপ যুদ্ধে ফায়দা লুটে তো শত্রুপক্ষ। শত্রুপক্ষটি তখন সামরিক আগ্রাসন, সীমাহীন লুণ্ঠন ও অধিকৃতির সুযোগ পায়। এমন ষড়যন্ত্রের রাজনীতি তাই আত্মঘাতি। এরূপ রাজনীতির কারণেই বাংলাদেশে এসেছে দুর্ভিক্ষ। এবং মানুষ পরিণত হয়েছে আন্তর্জাতিক ভিক্ষুকে। এবং দেশের উপর আধিপত্য বেড়েছে ভারতের।

 

বিভক্তি আযাব ডেকে আনে

মুসলিম হওয়ার অর্থ, জীবনের প্রতি মুহুর্তে এবং প্রতিক্ষেত্রে মহান আল্লাহতায়ালার আজ্ঞাবহ সৈনিক হওয়া। রাজনীতির অঙ্গণে সে দায়িত্বটি হলো সর্বশক্তিমান মহান রাব্বুল আলামীনের খেলাফত তথা প্রতিনিধিত্বের। প্রশ্ন হলো, মহান আল্লাহতায়ালা কি তাঁর সৈনিক বা খলিফাদের মাঝে বিভক্তি পছন্দ করেন? বরং নির্দেশ হলো, “তোমরা আল্লাহর রশিকে (তথা কোরআনকে) শক্তভাবে একত্রে আঁকড়ে ধরো এবং পরোস্পরে বিভক্ত হয়ো না।-(সুরা আল-ইমরান আয়াত ১০৩)। মুসলিম উম্মাহর মাঝে বিভক্তি মহান আল্লাহতায়ালার কাছে এতোটাই অপছন্দের যে, ভয়ানক গজব নামিয়ে আনার জন্য নাস্তিক হওয়া বা পুতুল পূজারী হওয়ার প্রয়োজন পড়েনা;নিজেদের মাঝে বিভক্তি গড়াটাই সে জন্য যথেষ্ট। পবিত্র কোরআনে সে হুশিয়ারটি দেয়া হয়েছে এভাবে,“এবং তোমরা কখনই তাদের মত হয়োনা যারা (আল্লাহর পক্ষ থেকে) সুস্পষ্ট নির্দেশাবলী আসার পরও পরস্পরে বিভক্ত হলো এবং মতভেদ গড়লো, এবং তাদের জন্য রয়েছে কঠিন আযাব।” –(সুরা আল-ইমরান,আয়াত ১০৫)। পবিত্র কোরআনের উপরুক্ত আয়াতটিতে যা সুস্পষ্ট তা হলো, বিভক্তি মুসলিমের জীবনে একাকী আসে না। সাথে ভয়ানক আযাবও আনে।

লন্ডনের “দি গার্ডিয়ান” পত্রিকায় ৮/১২/২০১৫ তারিখে ইউরোপীয় পার্লামেন্টের প্রেসিডেন্টি মার্টিন শুল্জের একটি বক্তব্য ছাপে। সে বক্তব্যটি প্রথমে জার্মান পত্রিকা “Die Welt”য়ে ছাপা হয়,সেটিই ছাপে গার্ডিয়ান।মি. মার্টিন শুল্জ বলেন, “The Europe is in danger and no one can say whether EU will still exist in 10 years time. Alternative to EU would be a Eurrope of nationalism, a Europe of borders and walls.That would be horrific because such a Europe has reeatedly led in the past to catastrophe.”  অনুবাদঃ “ইউরোপ বিপদের মুখে;এবং কেউই বলতে পারে না যে আজ থেকে ১০ বছর পরও ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন বেঁচে থাকবে। ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের বিকল্প হলো জাতীয়তাবাদের ইউরোপ; সেটি সীমারেখা ও দেয়াল দিয়ে বিভক্ত ইউরোপ। তেমনিটি হলে তা অতি ভয়াবহ হবে। কারণ, তেমনবিভক্ত ইউরোপ অতীতে ভয়াবহ বিপর্যের দিকে নিয়ে গেছে।” কোন ভূখণ্ডে সীমান্ত রেখার দেয়াল গড়া শুরু হলে সেখানে ঘৃনাও বাড়ে। বর্ণ, ভাষা, গোত্র বা আঞ্চলিকতার নামে ঘৃনা বাড়ানো হয় বিভক্তির সে দেয়ালগুলোকে বাঁচিয়ে রাখার স্বার্থে। সে ঘৃনা রক্তাক্ষয়ী যুদ্ধও ডেকে আনে। ইউরোপে তাই বার বার যুদ্ধ এসেছে। কখনো সেটি ৩০ বছরের যুদ্ধ, কখনো ১০০ বছরের যুদ্ধ। কখনো বা বিশ্বযুদ্ধ। প্রতিটি যুদ্ধে বিপুল সংখ্যক মানুষের প্রান নাশ ঘটেছে। দুটি বিশ্বযুদ্ধে সাড়ে সাত কোটি মানুষের জীবনে মৃত্যু ডেকে এনেছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠার পর ইউরোপবাসী যেমন রাজনৈতিক বিভক্তি থেকে মুক্তি পেয়েছে, তেমনি মুক্তি পেয়েছে যুদ্ধ থেকেও। মি. মার্টিন শুল্জ এজন্য চিন্তিত যে, বিভিন্ন ভাষা ও ভূগোলের নামে ইউরোপ আবার বিভক্ত হতে যাচ্ছে। মি. শুল্জ মুসলিম নন। একতা গড়া তার উপর ধর্মীয় ভাবে ফরজও নয়। কিন্তু দেয়াল গড়ার বিপদ নিয়ে তিনি আতংকিত। ইতিহাস থেকে সংগৃহীত তার দলিলটি হলো, বিভক্তিতে কল্যান নাই। বরং আছে ভয়াবহ যুদ্ধ, হত্যাকাণ্ড, ধ্বংস ও বিপর্যয় –অতীতে ইউরোপ যা বার বার দেখেছে। তেমন মহা বিপর্যয় থেকে বাঁচানোর স্বার্থেই তিনি সীমান্ত রেখার নামে দেয়াল দিয়ে বিভক্ত ইউরোপের বিরুদ্ধে হুশিয়ারি উচ্চারন করেছেন। সীমান্ত রেখা দিয়ে মুসলিম বিশ্বকে খণ্ডিত করার মাঝে মুসলিমদেরও কোন কল্যাণ নাই, বরং আছে মহাশাস্তি ও বিপর্যয়। মহান আল্লাহতায়ালা চান সেরূপ বিপর্যয় থেকে মুসলিমদের বাঁচাতে। তাই মুসলিমদের মাঝে বিভক্তির দেয়াল গড়া ইসলামে হারাম। মহান আল্লাহতায়ালার সে নির্দেশের প্রতি আনুগত্য নিয়েই ১৯৪৭ সালে পাঞ্জাবী, সিন্ধি, পাঠান, বেলুচ ও ভারত থেকে আসা মুহাজিরদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে বাঙালী মুসলিমগণ অখণ্ড পাকিস্তান গড়েছিল। সেটিই ছিল প্রাথমিক যুগের মুসলিমদের আদর্শ। তাঁরা শুধু ইসলামের প্রচারই করেননি; ভাষা, বর্ণ ও আঞ্চলিকতার দেয়ালগুলোকেও ভেঙ্গেছেন। ফলে আরব, কুর্দ, তুর্ক, ইরানী, মুর ও অন্যান্য ভাষাভাষি মুসলিমগণ তখন এক উম্মতে একাকার হয়ে গেছে। সে একতার বলে মুসলিম উম্মাহ পরিণত হয়েছে অপ্রতিদ্বন্দী বিশ্বশক্তিতে। অথচ শেখ মুজিব ও তার দলের রাজনীতিটি ছিল উল্টো পথে; সেখানে গুরুত্ব পেয়েছে ভাষা ও বর্ণের নামে মুসলিমদের মাঝে দেয়াল গড়া। তাতে খণ্ডিত ও শক্তিহীন শুধু পাকিস্তান হয়নি, দুর্বল হয়েছে বাংলাদেশও। মুসলিমদের শক্তিহীন করার সে কাজে মুজিবকে মদদ জোগাতে ভারতের ন্যায় শত্রুপক্ষ দুপায়ে খাড়া ছিল। মুসলিম বিশ্বের সর্ববৃহৎ সে রাষ্ট্রটির মেরুদণ্ডটি ভাঙ্গার কাজে তারা নিজ খরচে যুদ্ধ করে দিতে ১৯৪৭ থেকেই রাজী ছিল। একাত্তরে তো সেটিই হয়েছে। মুজিব এভাবে বাঙলী মুসলিমদের শক্তিহানিই শুধু করেননি, ভাতৃঘাতি বিভক্তি ও যুদ্ধের পথে টেনে আযাবের পথেও টেনেছেন। মুজিবের কি এটি কম অপরাধ?

ইতিহাসে এমন নজির নেই, মুসলিমগণ তাদের নিজ ভূমিকে খণ্ডিত করলো অথচ তাদের উপর আযাব নেমে এলো না। শতবছর আগেও আরব বিশ্বে এতো বিভক্তি এবং এতো ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাষ্ট্র ছিল না। ফলে আরব ভূমির উপর তখন বিদেশী শক্তির এতো বোমাবর্ষণ, এরূপ দখলদারি এবং  গণহত্যা ছিল না। আরব ভূমি এখন ২২ টুকরোয় বিভক্ত; এ বিভক্তি ভয়ানক ভাবে বাড়িয়েছে তাদের দুর্গতি এবং অপমান। অঢেল সম্পদ থাকা সত্ত্বেও তারা ইতিহাস গড়ছে বিদেশে রিফিউজী রপ্তানিতে। শিশুরাও সাগরে লাশ হয়ে ভাসছে। এখন ইরাক, সিরিয়া, ফিলিস্তিন, ইয়েমেন, লিবিয়া, মিশর, লেবানন, বাহরাইনসহ আরব বিশ্বের অধিকাংশ দেশে চলছে যুদ্ধ। দিন দিন সে যুদ্ধের পরিধি দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। বহু লক্ষ আরব পুরুষ-মহিলা ও শিশু নিজ দেশ ও গৃহ ছেড়ে বিদেশে রিফিউজী রূপে নিগৃহীত জীবন বেছে নিতে বাধ্য হচ্ছে। এভাবে মুসলিম বিশ্বে যতই বাড়ছে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাষ্ট্রের নামে বিভক্তির দেয়াল, ততই বাড়ছে দুর্গতি।এমন গভীরতর হচ্ছে রক্তপাত। এরূপ দুর্গতি ও রক্তপাতকে কি মহান আল্লাহর রহমত বলা যায়। সম্ভবতঃ এটি হলো সেই আযাব -যার প্রতিশ্রুতি মহান আল্লাহতায়ালা সুরা আল-ইমরানের পূর্বোক্ত আয়াতে বর্ণনা করেছেন। মহান আল্লাহতায়ালা কি তাঁর নিজের প্রতিশ্রুতি পালনে বিলম্ব করেন বা সেটি ভূলে যান? মুসলিম উম্মাহর মাঝে বিভক্তি গড়া এজন্যই ঈমানদারের কাজ নয়, একাজ ইসলামের দুষমনদের।

আযাবের আলামত কি শুধু বিদেশী শত্রুর হামলা বা বোমা বর্ষন? স্বদেশী দুর্বৃত্তদের দখলদারি, স্বৈরাচার, গণহত্যা ও নির্যাতন কি আযাব? নিজভূমির নদ-নদী, সমুদ্র-উপকূল, জলবায়ু, বায়ু-প্রবাহও তখন আযাবের হাতিয়ারে পরিণত হয়। বাঙালী মুসলিমের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় বিভক্তিটি আসে ১৯৭১য়ে। সেটি বাংলা ভাষা ও বঙ্গভূমির নামে অবাঙালী মুসলিমদের থেকে  পৃথক হওয়ার মধ্য দিয়ে। অতীতে বাঙালী মুসলিমের জীবনে পরম বন্ধু গণ্য হওয়ার জন্য বাঙালী হওয়া জরুরী ছিল না। ইখতিয়ার মুহাম্মদ বিন বখিতিয়ার খিলজী, হযরত শাহ জালাল, হযরত শাহ মখদুম, হযরত শাহ আমানাত, হযরত খান জাহান আলী, নবাব শায়েস্তা খান, নবাব সিরাজুদ্দৌলা প্রমুখের ন্যায় বাঙালী মুসলিমের প্রধান প্রধান আপনজন গণ ছিলেন অবাঙালী। সে সব অবাঙালীদের সাথে বাঙালী মুসলিমের আত্মার সংযোগঠি ছিল অতি গভীর। বাঙালী মুসলিমের জীবনে প্রাণাধীক প্রিয় যে মহান নবীজী (সাঃ)-তিনিও বাঙালী নন। বাঙালী মুসলিমের মনের ভূখণ্ডে শয়তান ও তার অনুসারিগণ তখন ভাষা,বর্ণ বা আঞ্চলিকতার নামে বিভেদের দেয়াল খাড়া করতে পারিনি। তাই ১৯৪৭ সালে বাঙালী নেতাদের বাদ দিয়ে অবাঙালী কায়েদে আযম মুহাম্মদ আলী জিন্নাহকে নেতা রূপে বরন করতে তাদের আপত্তি হয়নি।বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়নি অবাঙালীদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠার কাজে আত্মনিয়োগ করায়।কিন্তু মুসলিম দেশে বিভক্তি গড়া তো শয়তান ও তার অনুসারিদের এজেন্ডা। তারাই বিপুল ভাবে বিজয়ী হয় ১৯৭১’য়ে। বিভক্ত গড়ার সে প্রকল্পে সহায়তা দেয় ভারত।বিভক্তির দেয়াল গড়া হয় ভাষা ও আঞ্চলিকতার নামে।প্যান-ইসলামীক চেতনার ন্যায় ইসলামের মৌলিক শিক্ষা থেকে এটিই হলো বাঙালী মুসলিমের জীবনে বড় বিচ্যুতি। তাতে ভেঙ্গে যায় বিশ্বের সর্ববৃহৎ মুসলিম রাষ্ট্র পাকিস্তান। এতো বড় বিভক্তির পর প্রতিশ্রুত আযাব আসবে না –সেটি কি কোন ঈমানদার বিশ্বাস করতে পারে? বাংলাদেশে একাত্তর-পরবর্তী দুর্ভিক্ষ, তলাহীন ভিক্ষার অপমান ও মুজিব সরকারের সন্ত্রাসে বহু লক্ষ মানুষের মৃত্যু এবং খোদ মুজিব ও তার নিজ পরিবারের সদস্যদের মৃত্যু -এগুলোকে কি আল্লাহর রহমত বলা যায়?

মুজিবের কাছে রাজনীতি পরিণত হয় বাঙালী মুসলিমদের বিভক্তির পথে তথা আযাবের পথে ধাবিত করার হাতিয়ারে। অপর দিকে কায়েদে আযম মুহম্মদ আলী জিন্নাহ নানা ভাষা, নানা বর্ণ, নানা ফিরকায় বিভক্ত মুসলিমদের একতার পথে পরিচালিত করেছেন। মুসলিম নেতাদের সেটিই তো মূল দায়িত্ব। এরূপ একতা মুসলিমের জীবনে মহান আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে মহান নিয়ামত বয়ে আনে। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান ছিল সে নিয়ামতপূর্ণ অর্জন। ইসলামে বিভক্তি গড়া যে হারাম-সে বিধানটি ভারতীয় কংগ্রেস নেতা করম চাঁদ গান্ধিও বুঝতেন। তাই মুসলিম লীগ যখন ভারত ভেঙ্গে পাকিস্তান গড়ার প্রস্তাব পাশ করে তখন কায়েদে আযম মোহম্মদ আলী জিন্নাহকে তিনি ইসলামের সে বিধানটির কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন। তখন মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর যুক্তি ছিল, মুসলিম লীগ কোন মুসলিম দেশ ভাঙ্গছে না।কায়েদে আযম বরং হিন্দু-সংখ্যাগরিষ্ঠ ভারত ভেঙ্গে বিশ্বের সর্ববৃহৎ মুসলিম দেশের জন্ম দিয়েছে। এটি তো বিশাল ছাওয়াবের কাজ। তাঁর আরো যুক্তি ছিল, মুসলিমগণ হিন্দুদের থেকে সর্বার্থে একটি আলাদা জাতি। প্রতি পরিবারের জন্য যেমন আলাদা ঘর লাগে, স্বতন্ত্র একটি জাতির জন্যও তেমনি স্বতন্ত্র দেশ লাগে। নইলে সে জাতি তার নিজের জীবন-লক্ষ্য ও জীবনাদর্শ নিয়ে বেড়ে উঠতে পারে না। মুসলিমগণ যেমন ধর্ম-কর্ম, নাম-ধাম ও পোষাক-পরিচ্ছদে হিন্দুদের থেকে ভিন্ন, তেমনি ভিন্ন হলো তাদের বাঁচা-মরা, রাজনীতি, প্রশাসন, আইন-আদালত ও শিক্ষা-সংস্কৃতির এজেন্ডা। এটিই ছিল জিন্নাহর ‘দ্বিজাতি’ তত্ত্ব। আর ঈমানদারদের উপর শুধু ফরয নামায-রোযা নয়,ফরয হলো আদালতে কোরআনী বিধান তথা শরিয়তকে মেনে চলা। ভারত হলো সংখ্যাগরিষ্ঠ অমুসলিমদের দেশ। ফলে শরিয়তী আইনের প্রতিষ্ঠা কি সে দেশে সম্ভব? সম্ভব কি স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসলামী শিক্ষানীতির প্রয়োগ? অথচ ইসলামী শিক্ষাছাড়া কি মুসলিম সন্তানদের মুসলিম রূপে বেড়ে উঠাটি নিশ্চিত করা যায়? ঈমানদারের মূল দায়বদ্ধতাটি হলো মহান আল্লাহতায়ালার প্রতিটি হুকুমের পূর্ণ আনুগত্য। আর শরিয়ত পালন ছাড়া কি পূর্ণ ইসলাম পালন সম্ভব? তাই শুধু নামায পালনের জন্য মসজিদ গড়লে মুসলিমের চলে না, শরিয়ত পালনের জন্য ইসলামী রাষ্ট্রও নির্মাণ করতে হয়। তখন অপরিহার্য হয়ে পড়ে মুসলিম উম্মাহর মাঝে একতাও। কারণ কারো পক্ষে একাকী রাষ্ট্র গড়া দূরে থাক, একখানি ঘর গড়াও তো অসম্ভব। একাকী সাধু-সন্যাসী হওয়া যায়, কিন্তু মুসলিম হওয়া যায় না। কারণ, মুসলিম হওয়া জন্য তাকে অন্যদের সাথে নিয়ে অবশ্যই ময়দানে নামতে হয় এবং বহু কিছুই করতে হয়।তার উপর অন্য মুসলিমদের সাথে সীসাঢালা দেয়ালসম একতা গড়া যেমন ফরজ, তেমনি ফরজ হলো ইসলামী রাষ্ট্রগড়ার জিহাদ। উপমহাদেশের মুসলিমদের জীবনে পাকিস্তান গড়াটি তাই জিহাদ গণ্য হয়েছিল। তেমনি একাত্তরে জিহাদ রূপে গুরুত্ব পেয়েছে দেশটির প্রতিরক্ষাও। মুজিব দেশটির গড়ায় অংশ নিলেও প্রতিরক্ষায় অংশ নেননি। কথা হলো, পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠা যদি ১৯৪৭’য়ে অতি প্রশংসনীয় কর্ম হয়ে থাকে তবে সেটির বাঁচানোর কাজটি একাত্তরে অপরাধ হয় কি করে? অথচ সে অপরাধেই পাকিস্থানপন্থিদের হত্যা করা হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে!

 

ষড়যন্ত্রের রাজনীতি

একাত্তরে যেসব ইসলামপন্থীগণ অখণ্ড পাকিস্তানের পক্ষ নিয়েছিল তারা কি পূর্ব পাকিস্তানীদের কল্যাণকে শেখ মুজিবের চেয়ে কম গুরুত্ব দিত? বাংলাদেশ কি শুধু মুজিব ও তার দলীয় অনুসারীদের জন্মভূমি? মুজিবের ন্যায় তারাও তো এ ভূমিতেই জন্ম নিয়েছে। এবং সেটি নিজ ইচ্ছায় নয়, মহান আল্লাহতায়ালার ইচ্ছায়। বাঙালী মুসলিমদের স্বার্থের প্রতি গভীর অঙ্গীকারের কারণে ১৯৪৭ সালে তারা পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তাদের যারা একাত্তরে বেঁচেছিলেন তারা ১৯৪৭’যের ন্যায় ১৯৭১ সালেও তারা সে মুসলিম স্বার্থের সাথে গাদ্দারি করেননি।  মুজিব থেকে তাদের মূল পার্থক্যটি হলো, পাকিস্তান ভাঙ্গার মধ্যে তারা বাঙালী মুসলিমের জন্য মহা অকল্যাণ ভেবেছে। তাদেরও দাবী ছিল, পূর্ব পাকিস্তানের ন্যায্য পাওনা দেয়া হোক। ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা পাক সমগ্র পাকিস্তান জুড়ে। এমনকি মুজিবের ৬ দফা প্রণয়নের প্রায় বিশ বছর আগেই তৎকালীন পূর্ব বাংলার মূখ্যমন্ত্রী জনাব নুরুল আমীন বাজেটে কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে প্রদেশের জন্য ন্যায্য হিস্যার দাবী নিয়ে তৎকালীন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী জনাব গোলাম মহম্মদের সাথে বিতন্ডায় জড়িয়ে পড়েছিলেন। পূর্ব-পশ্চিম দুই প্রদেশের বৈষম্য নিয়ে বহু পশ্চিম পাকিস্তানী রাজনৈতিক নেতারাও যে সোচ্চার ছিল সেটি কি শেখ মুজিব জানতেন না? এমনকি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানও সেটি স্বীকার করতেন। সে বৈষম্য কমিয়ে আনার গরজেই প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের আমলে কেন্দ্রীয় সরকারের চাকরিতে বহু বাঙালী অফিসারের দ্রুত পদ্দোন্নতি হয়েছিল এবং সেনাবাহিনীতে বেশী বেশী পূর্ব পাকিস্তানীদের নিয়োগের হুকুম হয়েছিল। সংখ্যার অনুপাতে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় পার্লামেন্টে পূর্ব পাকিস্তানের শতকরা ৫৬ ভাগ আসন মেনে নিয়েছিলেন ইয়াহিয়া খান।

প্রকৃত সত্য হলো, শেখ মুজিবের সাথে পাকিস্তানপন্থীদের মূল বিরোধটি প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন নিয়ে ছিল না। ছিল না দুই প্রদেশের মাঝে বৈষম্য দূরীকরণ নিয়ে, এমন কি মুজিবকে বা কোন বাঙালীকে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের প্রধান রূপে ক্ষমতায় বসানো নিয়েও ছিল না। এর আগে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী রূপে তিনজন পূর্ব পাকিস্তানী বসেছেন। এমনকি আওয়ামী লীগের নির্বাচনী বিজয়ের পর ইয়াহিয়া খান শেখ মুজিবকে পাকিস্তানের ভবিষ্যত প্রধানমন্ত্রী রূপে সাংবাদিকদের সামনে উল্লেখও করেছিলেন। শেখ মুজিবের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবী জানিয়ে পত্রিকায় বিবৃতি দিয়েছিলেন মুসলিম লীগ নেতা মমতাজ দওলাতানা, জামায়াতে ইসলামী নেতা মওলানা মওদূদী এবং জনাব গোলাম আযম এবং পাকিস্তান ডিমোক্রাটিক পার্টি প্রধান জনাব নুরুল আমীনও। সে আমলের পত্রিকা গুলো পড়লে তার প্রমাণ মিলবে। মুজিবের সাথে তাদের মূল বিরোধটি ছিল অখণ্ড পাকিস্তানের অস্তিত্ব নিয়ে। অখণ্ড পাকিস্তানের বিনাশে শেখ মুজিব তার নিজ সিদ্ধান্তটি নিয়ে ফেলেছিলেন নির্বাচনের বহু আগেই। তার নিজ কথায় সেটি ১৯৪৭ সালে। এবং সেটি সাধন করতে তিনি ভারতের সাথে ষড়যন্ত্রমূলক কোয়ালিশনও গড়েছিলেন। পাক-আমলের ২৩ বছর ধরে তিনি রাজনীতি করেছেন, বহু বক্তৃতা-বিবৃতি দিয়েছেন, সত্তরে নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন, মূলত সে স্ট্রাটেজীরই অবিচ্ছেদ্য অংশ রূপে। তাই ইসলামাবাদে গিয়ে ক্ষমতায় বসাতে তার কোন আগ্রহ ছিল না। ১৯৭০ সালে নির্বাচনি বিজয়ের পর তিনি তার রাজনীতির গোলপোষ্ট পাল্টিয়ে ফেলেন। যে ৬ দফার উপর তিনি নির্বাচন জিতেছিলেন সেটিকে তিনি আবর্জনার স্তূপে ফেলেছিলেন। ৬ দফাকে তিনি এক দফায় পরিণত করেন। সে এক দফাটি ছিল পাকিস্তান ভাঙ্গা এবং স্বাধীন বাংলাদেশ নির্মাণ। অনেকে বলেন মার্চে অনুষ্টিতব্য জাতীয় পবিষদের বৈঠক মুলতবি করার কারণে স্বাধীনতা আন্দোলনের শুরু। সেটি সত্য নয়। তার আগেই ১৯৭১য়ের জানুয়ারিতে শেখ মুজিব ছাত্রলীগের প্রাক্তন নেতাদের স্বাধীন বাংলাদেশ তৈরীর প্রস্তুতি নিতে বলেন। একাত্তরের ১০ ও ১৮ই জানুয়ারিতে প্রাক্তন ছাত্রলীগ নেতা আব্দুর রাজ্জাকের সাথে বৈঠকে শেখ মুজিব তা নিয়ে বিষদ পরিকল্পনা পেশ করেন। -(সাপ্তাহিক মেঘনা, ৪ ফেব্রেয়ারি, ১৯৮৭তে দেয়া আব্দুর রাজ্জাকের সাক্ষাতকার দ্রষ্টব্য)। সাপ্তাহিক মেঘনা’র সাথে উক্ত সাক্ষাতকারে আব্দুর রাজ্জাক একথাও বলেন, পূর্ব পাকিস্তানকে স্বাধীন করার লক্ষে স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ গঠিত হয় ১৯৬২ সালেই;শেখ মুজিব শুরু থেকেই তার সাথে জড়িত ছিলেন। ইনসাইড “র” বইয়ের লেখক অশোক রায়নার মতে ভারত সরকার ও তার গুপ্ততর সংস্থাও তার সাথে জড়িত ছিল। আরো জড়িত ছিলেন ছাত্রলীগের তৎকালীন কেন্দ্রীয় নেতা সিরাজুল আলম খান, কাজি আরেফ আহম্মদ ও আব্দুর রাজ্জাক।

ফলে মার্চে ইয়াহিয়া খান ও ভূট্টোর সাথে শেখ মুজিবের যে বৈঠক হয় -সেটির ব্যর্থতা অনিবার্য ছিল। শেখ মুজিবের ষড়যন্ত্রের রাজনীতি তখন চুড়ান্ত পর্যায়ে। ১৯৭১ য়ের ২৩ শে মার্চ ইয়াহিয়া খানের শেখ মুজিবের শেষ দাবী ছিল, সমগ্র পাকিস্তানের নয়, শুধু পূর্ব পাকিস্তানের ক্ষমতা তার হাতে দেয়ার। এবং সে সাথে পূর্ব পাকিস্তানের সর্বত্র থেকে সেনাবাহিনীকে তুলে নেয়ার। স্মরণীয় হলো, মুজিবের রাজনীতির মূল লক্ষ্যটি যে পাকিস্তান ভাঙ্গা ছিল -তা নিয়ে অন্ততঃ আওয়ামী লীগের মুজিব ভক্ত নেতাকর্মীদের মাঝেও কোন বিতর্ক নেই। বাংলাদেশের জন্ম নিয়ে আজও এটাই তাদের দলীয় ভাষ্য। এবং মুজিবের ষড়যন্ত্র মূলক রাজনীতির এটিই হলো চুড়ান্ত দলিল।ফলে একাত্তরের মার্চে ইয়াহিয়া-মুজিব-ভূট্টোর আলোচনা তাই বোধগম্য কারণেই ব্যর্থ হয়ে যায়। সে বৈঠককে সফল করা তথা পাকিস্তানকে বাঁচিয়া রাখার লক্ষ্যে একটি শাসনতান্ত্রিক মীমাংসায় পৌঁছা মুজিবের এজেন্ডা ছিল না। অপরদিকে পাকিস্তানের বিভক্তি মেনে নেয়া পাকিস্তানের সরকারের কাছেও অসম্ভব ছিল।কারণ এটি ছিল তাদের কাছে অনতিক্রম্য রেড লাইন। আর সেটি মেনে না নেয়াতেই মুজিব ও তার অনুসারিগণ পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করে। এবং সে যুদ্ধে তাদের কোয়ালিশন পার্টনার ভারতকেও ডেকে আনে।

 

ভারতীয় য়ের ষড়যন্ত্র

ভারতীয় গোয়েন্দাদের সাথে শেখ মুজিবের সংশ্লিষ্টতা নিয়ে বিস্তারিত লিখেছেন ভারতীয় লেখক ও সাংবাদিক অশোক রায়না। অশোক রায়নার বই থেকে একটা উদ্ধৃতি দেয়া যাকঃ “In order to present a clear synopsis of the events that finally brought RAW (Research & Analytic Wing: Indian spy agency) into the Bangladesh operation, one must review the intelligence activities that started soon after its formation in 1968. But by then Indian operatives had already been in contact with the “pro-Mujib” faction.  A meeting convened in Agartala during 1962-63 between the IB (Intelligence Bureau) foreign desk operatives and the Mujib faction, gave some clear indications of what was to follow. The meeting in Agortala had indicated to colonel Menon (which in fact was Sankaran Nair), the main liaison man between the Mujib faction and the Indian intelligence, that the “group” was eager to escalate their movement… They raided the armoury of East Bengal Rifles in Dhaka but this initial movement failed. In fact it was a total disaster. …A few months later, on January 6, 1968, the Pakistan government announced that 28 person would be prosecuted for conspiring to bring about the secession of East Pakistan, with the Indian help (which is known as Agartala conspiracy case in judicial history of Pakistan)”. –( Asoka Raina, Inside RAW: The Story of Indian Secret Service, page 49-50).

অনুবাদঃ “কি ধরণের ঘটনাবলী ভারতীয় গুপ্তচর সংস্থা RAW (Research & Analytic Wing) কে তার অপারেশনে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে টেনে নেয় তা নিয়ে একটি সুস্পষ্ট ধারণা পেতে হলে অবশ্যই ১৯৬৮ সালে RAW প্রতিষ্ঠা পাওয়ার পর থেকে তার কার্যক্রমকে পর্যালোচনা করতে হবে। ইতিমধ্যেই (অর্থাৎ RAW’য়ের প্রতিষ্ঠার পূর্ব থেকেই) ভারতীয় গুপ্তচরেরা মুজিবগ্রুপের সাথে সংযোগ গড়ে তুলে। আগরতলাতে ১৯৬২-৬৩ সালে ইনটেলিজেন্স বুরোর বিদেশ বিভাগের গুপ্তচর এবং মুজিবগ্রুপের সাথে যে বৈঠক হয়েছিল সেটিই একটি সুস্পষ্ট ধারণা দেয় যে সামনে কি হতে যাচ্ছে। আগরতলার সে মিটিংয়ে কর্নেল মেননকে (আসলে তিনি ছিলেন সাংকারান নায়ার) –যিনি ছিলেন মুজিবের লোক এবং ভারতীয় গুপ্তচর সংস্থার এজেন্টদের মাঝে সংযোগ রক্ষাকারি,এ ধারণা দেয়া হয়, তারা তাদের কাজকে আরো প্রবলতর করতে আগ্রহী। …তারা ইস্ট বেঙ্গল রাইফেলস ঢাকাস্থ অস্ত্রাগারে হামলা করে, কিন্তু প্রাথমিক এ হামলা ব্যর্থ হয়ে যায়। … আসলে এটি ছিল বিপর্যয়। … কয়েক মাস পরেই ১৯৬৮ সালের জানুয়ারিতে পাকিস্তান সরকার ঘোষণা দেয়, ভারতের সাথে ষড়যন্ত্র করে পূর্ব পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করার অভিযোগে ২৮ জনের বিরুদ্ধে বিচার করবে। এটাই পাকিস্তানের ইতিহাসে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা রূপে পরিচিত।

আগরতলা মামলা প্রসঙ্গে বাংলাদেশ সংসদের ডিপুটি স্পীকার এবং আওয়ামী লীগের নেতা অবঃ কর্নেল শওকত আলীর বক্তব্য, “আমরা তখন রাজনৈতিক কারণে অনেক কথাই বলেছি। তবে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় যে অভিযোগ দায়ের করেছিল তা শতভাগ ঠিক ছিল। আমাদের পরিক্ল্পনা শুরু হয় ১৯৬৪ সালে। ১৯৬৮ সালে আমরা ধরা পড়ি। পরিকল্পনা ছিল, একটি নির্দিষ্ট রাতের একটি নির্দিষ্ট সময়ে বাঙালী সৈন্যরা পূর্ব পাকিস্তানের সব সেনানিবাস দখল করে পাকিস্তানী সৈন্যদের অস্ত্র কেড়ে নেবে। এরপর মুজিব ভাইয়ের নেতৃত্বে স্বাধীনতা ঘোষণা করব।” -(দৈনিক প্রথম আলো, ৭/১২/২০০৯)।

অশোক রায়নার কথা, ভারতীয় গুপ্তচর সংস্থা “র” প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৬৮ সালে। কিন্তু শেখ মুজিবের সাথে ভারতীয় গোয়েন্দাদের যোগাযোগ ছিল তার বহু পূর্ব থেকে। সেটি ছিল ভারতীয় “আই.বি”(ইন্টটেলিজেন্স ব্যুরো)’র সাথে। মুজিব যে পাকিস্তান ভাঙ্গার ষড়যন্ত্রটি করেছেন সত্তরের নির্বাচনের বহু পূর্ব থেকেই সেটি তিনি নিজ মুখে বলেছেন পাকিস্তান থেকে ফেরার পর ‌১০ই জানুয়ারি রেসকোর্সের ময়দানে। বলেছিলেন, “স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠার লড়াই একাত্তর থেকে নয়, সাতচল্লিশ থেকে।” সে লক্ষ্যে তিনি  আগরতলাতেও গিয়েছিলেন। সে প্রমাণটি এসেছে এভাবেঃ আগরতলায় শেখ মুজিব সম্পর্কে ত্রিপুরার সাবেক মুখ্যমন্ত্রী শ্রী শচীন্দ্রলাল সিংহ বলেন, “১৯৬৩ সালে আমার ভাই এমএলএ শ্রী উমেশলাল সিং সমভিব্যহারে শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে ১০ জন ত্রিপুরার পালম জিলার খোয়াই মহকুমা দিয়া আগরতলায় আমার আগরতলার বাংলোয় রাত্র ১২ ঘটিকায় আগমন করেন। প্রাথমিক আলাপ-আলোচনার পর আমার বাংলো বাড়ি হইতে মাইল দেড়েক দূর ভগ্নী হেমাঙ্গিনী দেবীর বাড়িতে শেখ সাহেব আসেন। সেখানেই থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। তারপর মুজিবুর ভাইয়ের প্রস্তাব অনুযায়ী আমি আমাদের প্রধানমন্ত্রী পন্ডিত জওয়াহের লাল নেহরুর সাথে দেখা করি। আমার সাথে ছিলেন শ্রী শ্রীরমন চীফ সেক্রেটারি। তাকে (শ্রীরমনকে) শ্রী ভান্ডারিয়ার বিদেশ সচিবের রুমে রাখিয়া প্রধানমন্ত্রীর সাথে দেখা করি। তিনি মুজিবুর রহমানকে ত্রিপুরায় থাকিয়া প্রচার করিতে দিতে সম্মত হন নাই কারণ চীনের সাথে লড়াইয়ের পর এতোবড় ঝুঁকি নিতে রাজি হন নাই। তাই ১৫ দিন থাকার পর তিনি (শেখ মুজিব) ত্রিপুরা ত্যাগ করেন। শেখ মুজিবুর রহমানকে সর্বপ্রকার সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়।”–(সাহিদা বেগম, ২০০০, প্রকাশনায় বাংলা একাডেমী)।

সম্প্রতি বাংলাদেশের সৃষ্টিতে ত্রিপুরা রাজ্যের অবদানকে তুলে ধরার স্বার্থে “বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ত্রিপুরা” নামে একটি প্রামাণ্য চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে।ত্রিপুরার রাজ্যপাল তথাগত রায় ১৬/১২/২০১৫ তারিখে আগরতলায় ঐই চলচ্চিত্রটি উন্মোচন করেন।সে খবরটি পরেবেশন করে বিবিসি বাংলা সার্ভিস।উক্ত তথ্যচিত্রের গবেষক হলেন আগরতলার সিনিয়র সাংবাদিক মানস পাল। তার গবেষণায় বেরিয়ে আসে,শেখ মুজিব যে আগরতলায় গেছেন এবং পাকিস্তান ভাঙ্গার কাজে ভারত সরকারের সাহায্য চেয়েছেন -তা নিয়ে কোন দ্বিমত নেই।দ্বিমত হলো কোন সময় ভারত গেছেন -তা নিয়ে।কেউ কেউ বলেন,মুজিব ১৯৬৩ সালে আগরতলায় যান।আরেক পক্ষের মতে সেটি ১৯৬২ সালে। মানস পাল বলেন,শেখ মুজিবুর রহমান একবারই আগরতলায় আসেন -যার সাল তারিখ নিয়ে গবেষকদের মধ্যে মতান্তর রয়েছে।বেশিরভাগ মানুষই মনে করেন তিনি ১৯৬৩ সালে এসেছিলেন।(সাবেক মুখ্যমন্ত্রী শ্রী শচীন্দ্রলাল সিংহের দেয়া বক্তব্যে ১৯৬৩ সালের কথা বলা হয়েছে)।আমরা খোয়াইয়ের তৎকালীন সাবডিভিশনাল অফিসার স্মরজিৎ চক্রবর্তীর ডায়েরি পেয়েছি,যেখানে শেখ মুজিবুর রহমানের আগরতলায় আসার তারিখ উল্লেখিত আছেঃ “৫ ফেব্রুয়ারি,১৯৬২ সাল,সোমবার,শেখ মুজিবুর রহমান নামে একজন ব্যক্তি এবং তাঁর সঙ্গে আমীর হুসেন এবং টি চৌধুরী আসারামবারিতে (খোয়াই এবং তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের সীমান্ত)পৌঁছেছেন আজ দুপুর একটায় এবং তাদের ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্টেটের নির্দেশে তেলিয়ামুড়ায় পাঠানো হয়েছে।” মি.মানস পাল বলেন,“ত্রিপুরার তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী শচীন্দ্রলাল সিংহ শেখ মুজিবের আর্জি পৌঁছিয়ে দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী নেহরুর কাছে।তবে পাকিস্তানী গোয়েন্দাগণ এ খবর জেনে যায়।ফলে তাঁকে পাকিস্তানে ফেরত পাঠানোর জন্য কিছুটা আনুষ্ঠানিকতার প্রয়োজন হয়েছিল।তাঁকে পুশব্যাক করার আগে নিয়মরক্ষার জন্য একরাত আগরতলায় জেলে রাখতে হয়েছিল।“ রিপোর্টে আর বলা হয়,আগরতলা মামলার অন্যতম দুই আসামী স্টুয়ার্ড মুজিবুর রহমান এবং আলি রেজা বিলোনিয়া দিয়ে ত্রিপুরায় এসে একজন ভারতীয় গোয়েন্দা কর্মকর্তা কর্ণেল মেননের সাথে শালবাগানে দেখা করে ভারতের সাহায্য চেয়েছিলেন।কর্নেল মেনন (আসল নাম হলো শঙ্করণ নায়ার)পরবর্তীতে ভারতের গুপ্তচর সংস্থা রিসার্চ এন্ড এনালিসিস উইং (RAW) এর দ্বিতীয় প্রধান হয়েছিলেন।(অশোক রায়নার বই Inside RAW’তেও একই রূপ বর্ননা পাওয়া যায়)।

পাকিস্তান ভাঙ্গার কাজে ভারতীয় ষড়যন্ত্রের সাথে শেখ মুজিবের সংশ্লিষ্টতা নিয়ে সাক্ষ্য দিয়েছেন প্রখ্যাত ভারতীয় কলামিস্ট কুলদীপ নায়ার।তিনি লিখেছেনঃ “As far as our role in East Bengal is concerned, my impression is…. India decided to encourage East Bengalis to demand independence. We started exploiting the differences between Bengalis and the Punjabis…You will recall Agartala Conspiracy Case.  ..there is no doubt that Sheikh Mujib did come to India before that… When New Delhi discovered his presence in India, he was told immediately to go back and fight his battle there, because it was too embarraising for us. The Agartala Case …did not give them a bad name. In fact it made them heroes, so they were not afraid to get the help of India. Tajuddin Ahmed told me, “That was the time when we thought that East Pakistan could become an independent Bangladesh”. –(Nayar, K; 1972).  অনুবাদঃ পূর্ব বাংলা বিষয়ে আমার ধারণা হলো, …স্বাধীনতার দাবিতে পূর্ব বাংলার বাঙালীদের উৎসাহ দেয়াই ছিল ভারতের সিদ্ধান্ত।বাঙালী ও পাঞ্জাবীদের মধ্যে যে পার্থগুলো ছিল সেগুলো আমরা কাজে লাগাতে থাকি।… আপনাদের স্মরণে আছে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার কথা।…এ নিয়ে কোন সন্দেহ নেই যে শেখ মুজিব তার পূর্বেই ভারতে এসেছিলেন।…যখন নয়া দিল্লি কর্তৃপক্ষ ভারতে তার উপস্থিতি টের পায় তখনই তাকে সত্বর ফিরে যেতে বলা হয় এবং বলা হয় সেখানে গিয়ে লড়াই করতে।কারণ ভারতে তার উপস্থিতিটি ছিল বিব্রতকর।…তবে আগরতলা ষড়যন্ত্রটি তাদের জন্য বদনামের কারণ হয়নি।বরং সেটি তাদেরকে বীরের মর্যাদা দেয়।ফলে ভারতের সাহায্য চাইতে তারা আর ভয় পায়নি।বরং তাজউদ্দীন আহমেদ আমাকে বলেছিলেন,“সে সময় থেকেই আমরা ভাবতে শুরু করি পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীন বাংলাদেশ হবে।”

এ প্রসঙ্গে আরো দলিল হলো,আগরতলা ষড়যন্ত্রের অন্যতম প্রধান আসামী লেফ্টন্যান্ট কম্যান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেনের স্ত্রীর স্বীকারুক্তি। ঢাকা থেকে প্রকাশিত দৈনিক পূর্বদেশের ১৯৭২সালের ২৬শে মার্চ সংখ্যায় এক সাক্ষাতকারে তিনি বলেন,“ভারতের সাথে আমার স্বামীর গুপ্ত সম্পর্ক ছিল। তিনি গোপনে কয়েকবার আগরতলাতেও যান।”ভারতের সাথে মুজিবের গোপন ষড়যন্ত্র চলছিল বহুদিন ধরে। পাকিস্তান সরকারের গোয়েন্দাদের কাছে সেটি চুড়ান্ত ভাবে ধরা পড়ে ১৯৬৮ সালে। ১৯৬৮ সালের ৬ই জানুয়ারি পাকিস্তানের সরকারি প্রেসনোটের বরাত দিয়ে এপিপি জানায়,একটি রাষ্ট্রবিরোধী ষড়যন্ত্রে জড়িত থাকার অভিযোগে গত মাসে পূর্ব পাকিস্তানে ২৮ ব্যক্তিকে গ্রেফতার করা হয়েছে। ষড়যন্ত্রটি গত মাসে উদঘাটিত হয়। ধৃত ব্যক্তিগণ পূর্ব পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টায় লিপ্ত ছিল। ষড়যন্ত্র সফল করার জন্য প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র, গোলাবারুদ এবং অর্থ সংগ্রহ করাই তাদের উদ্দেশ্য ছিল।– (সাহিদা বেগম, ২০০০)। বাংলাদেশে এখনও বহু লোকের ধারণা, মুজিব স্বাধীন বাংলাদেশ চাননি,বরং ইয়াহিয়া খান তার ঘাড়ে সেটি চাপিয়ে দিয়েছেন। এবং সামরিক বাহিনীর সহিংস ভুমিকার কারণে মুজিবও স্বাধীনতার পথ বেছে নিতে বাধ্য হয়েছেন। উপরুক্ত তথ্যগুলি তাদের বোধোদয়ে সহায়ক হতে পারে।

 

মিথ্যাচারী রাজনীতি

যে কোন ষড়যন্ত্রের মূল কথা হলো, সেটি করতে হয় অতিশয় সংগোপনে। প্রকাশ্যে যে কাজ হয় তাকে কেউ ষড়যন্ত্র বলে না। ষড়যন্ত্রকারীদের এজন্যই পদে পদে মিথ্যা বলতে হয়। এবং মিথ্যা বলতে হয় সত্যের ন্যায় অতি প্রাঞ্জল ভাবে। ষড়যন্ত্রকারিরা এজন্যই প্রচণ্ড মিথ্যাবাদী হয়। শেখ মুজিবের সে ক্ষেত্রে পারদর্শীতা ছিল। মিথ্যাভাষণ তিনি শেষ অবধি চালিয়ে গেছেন। তাই পাকিস্তানের জেল থেকে বেরিয়ে যখন লন্ডন হয়ে ফিরছিলেন তখনও লন্ডনে “দি টাইমস” এর সাংবাদিক এ্যান্থনি ম্যাসক্যারেনহাসকে বলেছিলেন, “..going to keep some link with Pakistan” – (Anthony Mascarenhas, Bangladesh: A legacy of Blood, Chapter 5)। অনুবাদঃ “যাচ্ছি পাকিস্তানের সাতে একটি সংযোগ রাখার জন্য।” অথচ দেশে ফিরে বললেন তার উল্টোটি। সোহরোওয়ার্দী উদ্যানের জনসভায় বললেন, “পাকিস্তানের সাথে আর কোন সম্পর্ক নয়।”  তিনি বরং ২৫ বছরের দাস-চুক্তি স্বাক্ষর করলেন ভারতের সাথে।

শেখ মুজিব যে পাকিস্তান ভেঙ্গে বাংলাদেশে বানাতে চান সেটি দেশবাসীকে কখনই প্রকাশ্যে বলেননি। ১৯৭০ সালের নির্বাচনী জনসভাগুলোতে যেমন বলেননি, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় যখন অভিযোগ উঠেছিল তখনও বলেননি। বরং পাকিস্তান ভাঙ্গার ষড়যন্ত্রে জড়িত থাকার কথা বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে কসম খেয়ে অস্বীকার করেছিলেন। অভিযোগের জবাবে নিজ জবানবন্দীতে বলেছিলেন, “আমি কখনও পূর্ব পাকিস্তানকে পশ্চিম পাকিস্তান হইতে বিচ্ছিন্ন করিবার জন্য কোন কিছু করি নাই, কিংবা কোনোদিনও এই উদ্দেশ্যে কোনো স্থল, নৌ বা বিমান বাহিনীর কোনো কর্মচারীর সংস্পর্শে কোনো ষড়যন্ত্রমূলক কার্যে আত্মনিয়োগ করি নাই।”–(সাহিদা বেগম, ২০০০)। শেখ মুজিব বহুশত বক্তৃতা দিয়েছেন, ঘরে বাইরে বহুলক্ষ বাক্যও উচ্চারণ করেছেন, কিন্তু কখনই পাকিস্তান থেকে পূর্ব পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করার পক্ষে একটি কথাও প্রকাশ্যে বলেননি। দলীয় কোন সম্মেলনে যেমন বলেননি, তেমনি কোন সাংবাদিকদের সাথে সাক্ষাৎকারেও বলেননি। বাংলাদেশ স্বাধীন করার পক্ষে কোন দলীয় প্রস্তাবও পাশ করাননি। ফলে বাংলাদেশ সৃষ্টির পর আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা বিপদে পড়ে, স্বাধীনতার ঘোষক নিয়ে। স্বাধীনতার ঘোষক রূপে ইতিহাসে আনা হয় পাকিস্তান আর্মির এক বিদ্রোহী মেজর জিয়াউর রহমানকে। শেখ মুজিব বাংলাদেশের স্বাধীনতার কথা প্রথমবার বললেন ১৯৭২ সালের ১০ই জানুয়ারিতে রেসকোর্সের (আজকের সোহরাওয়ার্দী উদ্দান) জনসভায়। এভাবে শেখ মুজিব নিজেই প্রমাণ করলেন, পাকিস্তান সরকার এতোদিন যা বলেছে সেটি মিথ্যা ছিল না। আগরতলা মামলাটিও মিথ্যা ছিল না।  বরং মুজিব যা বলে এসেছেন সেটিই ছিল মিথ্যা। ষড়যন্ত্র করেছেন তিনি নিজে। সত্তরের নির্বাচনে শেখ মুজিব যে শুধু ইয়াহিয়া খানের দেয়া লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক মেনে নিয়ে নির্বাচনে নেমেছেন তা নয়, প্রতি নির্বাচনী জনসভাতে জয়বাংলার সাথে  “পাকিস্তান জিন্দাবাদ” ধ্বনিও দিয়েছেন। কিন্তু নির্বাচনী জনসভায় দেয়া পাকিস্তানে জিন্দাবাদ ধ্বনি কি শেখ মুজিবের গোপন মনের প্রতিধ্বনি ছিল? এটি কি নিছক জনগণকে ধোকা দেয়ার জন্য ছিল না?

রাজনীতি আত্মসমর্পণের

ভারতীয় ষড়যন্ত্র, শোষণ ও আধিপত্যের মুখে বাংলাদশে আজ যে কতটা অসহায় সেটি কোন সচেতন বাংলাদেশীরই অজানা নয়। অনেকেই তা নিয়ে প্রতিবাদ মুখরও। কিন্তু বাংলাদেশের সামর্থ্য নেই গোলামীর এ বেড়াজাল থেকে থেকে বেরিয়ে আসার। আওয়ামী লীগের নেতাদের একমাত্র লক্ষ্য, যে কোন ভাবেই হোক ক্ষমতা লাভ–সেটি যদি ভারতের কাছে আত্মসমর্পণ করেও হয়। সেটির প্রমাণ মেলে ভারতের সাথে তাজউদ্দীনের তথাকথিত স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের ১৯৭১’য়ের অক্টোবরে স্বাক্ষরিত আত্মসমর্পণের চুক্তিটি দেখে। চুক্তির শর্তাবলী ছিলঃ এক). বাংলাদেশের কোন সেনাবাহিনী থাকবে না, থাকবে একটি প্যারা মিলিটারি বাহিনী। দুই). বাংলাদেশের প্রশাসনে ভারতীয়দের রাখতে হবে। তিন). ভারতীয় বাহিনী বাংলাদেশে স্থায়ী ভাবে থাকবে। চার). সীমান্তে তিন মাইল এলাকা জুড়ে কোন মুক্ত বাণিজ্যিক এলাকা থাকবে। -(The Tide, January, 1990)।

বাংলাদেশের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের এ হলো বড় রকমের ষড়যন্ত্র ও বিশ্বাসঘাতকতা। তবে ভারতের সাথে স্বাক্ষরিত সে চার দফা চুক্তি নিয়ে এগুতে হয়নি। ভারত সে চুক্তিতে যা চেয়েছিল, মুজিব সরকার দিয়েছে তার চেয়ে অনেক বেশী। চুক্তিতে সীমান্তের তিন মাইল জুড়ে মুক্ত বাণিজ্যের কথা ছিল, কিন্তু বাস্তবে সমগ্র দেশ পরিণত হয় ভারতের মুক্ত বাজার। ইন্দিরা গান্ধি ভেবেছিল এতোটুকু অর্জন করতে হলে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ভারতীয় সেনাবাহিনী ও প্রশাসনে ভারতীয়দের বসাতে হবে। কিন্তু তার সে ধারণা ভুল প্রমাণিত হয়েছে। শেখ মুজিব এবং তার রাজনৈতিক ক্যাডার ও প্রশাসনিক কর্মকর্তারা ভারতীয়দের চেয়েও বেশী ভারতীয় স্বার্থের পাহারাদারে পরিণত হয়। ভারতীয় সাহায্য ভিক্ষা করতে যে নেতা নিজে ৬০’এর দশকেই আগারতলা গিয়েছিলেন, এমন নেতার কি কোন মেরুদণ্ড থাকে? তিনি যে ভারতীয় সাহায্য অব্যাহত রাখার আশায় নিজ দেশের সীমান্ত খুলে দিবেন সেটিই কি স্বাভাবিক নয়? বাংলাদেশী ভূমি বেরুবাড়ী লাভে ভারতকে এজন্যই কোন যুদ্ধ লড়তে হয়নি। ১৯৭৪ সালের ১৬ই মে মুজিব চুক্তি দস্তখত করে ভারতের হাতে তুলে দিয়েছেন। অথচ চুক্তি মোতাবেক বাংলাদেশের ছিট মহলে যেতে যে তিন বিঘা জমি প্রাপ্য ছিল -সেটি তিনি আদায় করতে পারেন নি। সে প্রাপ্য তিন বিঘা না পাওয়া নিয়ে শেখ মুজিবের যেমন কোন মাথা ব্যাথা ছিল না, প্রতিবাদও ছিল না। মাথা ব্যাথা বা প্রতিবাদ পরবর্তি কালের আওয়ামী লীগ সরকারেরও ছিল না। শেখ মুজিব এবং আওয়ামী লীগ নেতাদের একমাত্র ক্ষোভ শুধু পাকিস্তানের বিরুদ্ধে। অথচ পাকিস্তান আমলের ২৩ বছরে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানকে এক ইঞ্চি ভূমিও ভারতের হাতে হারাতে হয়নি। পাকিস্তান আমলে ভারত ফারাক্কা বাঁধও চালু করতে পারেনি। প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান ভারতকে হুশিয়ার করে দিয়েছিলেন, ফারাক্কা চালু করা হলে বাঁধের উপর পাকিস্তান বোমা ফেলবে। ভারতের প্রতি শেখ মুজিবের এমন নতজানু চরিত্র সে সময়ের পাকিস্তানপন্থী নেতাকর্মী ও আলেমদের অজানা ছিল না। সে কারণেই আজ যা হচ্ছে সেটির পূর্বাভাস তারা ১৯৭০’য়েই দিতে পেরেছিলেন।

 

ষড়যন্ত্র সত্য লুকানোর

মুজিবের রাজনীতির গোপন এজেন্ডাটি যদিও অনেকে বহু আগে থেকেই জানতেন, তবে সবার সামনে সেটি প্রকাশ পায় সত্তরের নির্বাচনের পর। যারা বলেন, আওয়ামী লীগ স্বাধীনতার পথ ধরেছে ২৫শে মার্চে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সামরিক হস্তক্ষেপের পর, তারা সঠিক বলেন না। এ মতের প্রবক্তা হলেন জনাব আবুল মনসুর আহম্মদ। তার বক্তব্য, “১৯৭১ সালের  ২৫শে মার্চের আগে পূর্ব-পাকিস্তানের একজনও পাকিস্তান ভাংগিবার পক্ষে ছিল না; ২৫শে মার্চের পরে একজন পূর্ব-পাকিস্তানীও পাকিস্তান বজায় রাখিবার পক্ষে ছিল না।”–(আবুল মনসুর আহম্মদ, ১৯৮৯)। জনাব আবুল মনসুর আহম্মদের এ কথাটি শুধু অসত্যই নয়, সত্যের সাথে মস্করাও। তবে এ মিথ্যা কথনের মধ্যেও গভীর রাজনীতি আছে। সেটি হলো, শেখ মুজিবের অপরাধ ও তার ষড়যন্ত্রের রাজনীতিকে আড়াল করা। অতি দুর্বৃত্তও ইতিহাসে ষড়যন্ত্রকারি রূপে নাম লেখাতে চায় না। সেটি চায় না শেখ মুজিবসহ কোন আওয়ামী লীগ নেতাও। আজ হোক, কাল হোক, শত বছর পরে হোক বাংলাদেশের মানুষের মাঝে ইসলামের চেতনার জোয়ার আসবেই। সত্যকে চিরকাল চেপে রাখা যাবে না। সেদিন শেখ মুজিবের ষড়যন্ত্রের রাজনীতির মুখোশ উম্মোচিত হবেই। উম্মোচিত হবে ভারতীয় শত্রুদের সাথে তাঁর সংশ্লিষ্টতার কথা। আর ভারতের মত একটি শত্রু রাষ্ট্রের সাথে সংশ্লিষ্টতাই ইতিহাসের পাতায় তার নামকে কালিমাময় করার জন্য যথেষ্ট। রক্ষিবাহিনী, ভারতীয় সেনা বাহিনী, আওয়ামী ক্যাডার বাহিনী –কোন বাহিনী দিয়েই ইতিহাসের বই থেকে সে কালিমা মুছা যাবে না। অন্যরা না বুঝলেও আবুল মনসুর আহম্মদ বুঝতেন। কারণ বুদ্ধিবৃত্তির ক্ষেত্রে তিনি নির্বাধ ছিলেন না। তাই্ এই প্রবীন আওয়ামী লীগ নেতা তাঁর আওয়ামী লীগ দলীয় বন্ধুদের চরিত্র বাঁচাতে সত্যকে লুকাতে চেয়েছেন। এবং মিথ্যার আশ্রয় নিয়েছেন।

১৯৭১-এর মার্চের প্রথম সপ্তাহ থেকে প্রায় ২০ শে এপ্রিল অবধি দেশের বিভিন্ন জনপদ ও  রাজপথ যখন আওয়ামী লীগের পুরাপুরি দখলে ছিল তখন যে হাজার হাজার অবাঙালী নিহত হলো, বহু অবাঙালী মহিলা ধর্ষিতা হলো এবং যে খবর বহু বিদেশী পত্রিকাতেও ছাপা হলো -সেটিকেও জনাব আবুল মনসুর আহম্মদ তার বইয়ে মিথ্যা বলেছেন। তিনি লিখেছেন, “আওয়ামী লীগকে দোষী সাব্যস্ত করিবার জন্য পরবর্তীকালের (৫ই আগস্ট) (পাকিস্তান সরকারের প্রকাশিত) “হোয়াইট পেপারে” আর অনেক কথা বলা হইয়াছিল। তার প্রধান কথাটা এই যে, ২রা মার্চ হইতে আওয়ামী লীগের  “তথাকথিত অহিংস অসহযোগ আন্দোলন” শুরু হওয়ার সাথে সাথেই আওয়ামী লীগ ভলান্টিয়াররা তাদের উস্কানিতে বাংগালীরা অবাংগালীদের উপর বর্বর নির্যাতন ও হত্যাযজ্ঞা শুরু করে। কথাটি যে সত্য নয় তার প্রমাণ প্রকাশিত “হোয়াইট পেপার” নিজে”।–(আবুল মনসুর আহম্মদ, ১৯৮৯)। অথচ বিপুল সংখ্যক অবাঙালী হ্ত্যাটিই হলো বাংলাদেশের ইতিহাসে বর্বরতার অতি কলংকিত ইতিহাস। পাকসেনা ও বিহারীদের হাতে অগ্নিসংযোগ ও গণহত্যা হয়েছে এর পরে। অনেক ক্ষেত্রে প্রতিক্রিয়া হিসাবে।

আবুল মনসুর আহমদ বলেছেন, “১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চের আগে পূর্ব-পাকিস্তানের একজনও পাকিস্তান ভাংগিবার পক্ষে ছিল না।”  প্রশ্ন হলো, শেখ মুজিব এবং আজকের আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দও কি আবুল মনসুর আহমদের এ ভাষ্যকে বিশ্বাস করে? শেখ মুজিব নিজে যেখানে “পাকিস্তান ভাঙ্গার শুরু সাতচল্লিশ থেকে বলেছেন” তবে সেটি কি মিথ্যা ভাষণ ছিল? আগরতলা ষড়যন্ত্র যে সত্য ছিল সেটি তো এখন ষড়যন্ত্রের সাথে সংশ্লিষ্টরাও স্বীকার করেন। ভারতীয় লেখক অশোক রায়না তার বই “ইনসাইড ‘র’ বইতে তো এ বিষয়টি প্রমাণ করেছেন যে, আওয়ামী লীগের সাথে ভারতীয় গুপ্তচর সংস্থা “র” এর আগে থেকেই সম্পর্ক ও সহযোগীতা ছিল। এবং সেটি পাকিস্তানকে খণ্ডিত করার লক্ষ্যে। একই কথা আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুর রাজ্জাকও বলেছেন। “২৫শে মার্চের পরে একজন পূর্ব-পাকিস্তানীও পাকিস্তান বজায় রাখিবার পক্ষে ছিল না”–জনাব আবুল মনসুর আহমদের এ কথাটিও কি সত্য? ২৫শে মার্চের পরও পাকিস্তানের পক্ষে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের বহু লক্ষ নেতা-কর্মী ছিল। অখণ্ড পাকিস্তান বাঁচাতে হাজার হাজার মানুষ সেদিন লড়াই করেছে বা সে লড়াইয়ে প্রাণ দিয়েছেন বা নির্যাতিত হয়েছেন-সেটি কি তিনি দেখেননি? ১৬ই ডিসেম্বরের পর যে বহু সহস্র মানুষকে দিয়ে জেলগুলো ভর্তি করা হলো -তারাই বা কারা? যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের নামে যেসব বাংলাদেশীদের বিরুদ্ধে আজ বিচারের কথা বলা হচ্ছে তারা কি তবে পশ্চিম পাকিস্তানী? আবুল মনসুর আহম্মদের এ বক্তব্যের মধ্য দিয়ে এটাই প্রমাণিত হয়, ষড়যন্ত্র ও সীমাহীন মিথ্যাচার শুধু বাংলাদেশের রাজনীতির ময়দানেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, প্রচণ্ড ভাবে ছেয়ে গেছে বুদ্ধিবৃত্তির ময়দানেও। দেশে আজও সে মিথ্যাচার বাঁধভাঙ্গা জোয়ারের ন্যায় প্রচণ্ড। বুদ্ধিবৃত্তির ময়দানে সে মিথ্যাচারটি হচ্ছে শেখ মুজিবের ষড়যন্ত্রের রাজনীতিকে মহামান্বিত করার স্বার্থে। এবং প্রচণ্ড মিথ্যাচার হচ্ছে, ইসলামপন্থী ও মুজিব-বিরোধীদের চরিত্রহননের কাজে। কথা হলো, মিথ্যা দিয়ে কি কখনও সত্যকে গোপন করা যায়? গোপন করা যায় কি ভারতের সাথে পাকানো পর্বত-সমান ষড়যন্ত্রকে? অথচ সত্যকে গোপন করার এরূপ ষড়যন্ত্র একাত্তরের ইতিহাসের সিংহভাগ জুড়ে। এবং ষড়যনন্ত্রের সে রাজনীতি শুধু মুজিবের একার নয়, তার বাকশালী অনুসারিদেরও।

গ্রন্থপঞ্জি

  • অশোকা রায়না,১৯৯৬;ইনসাইড র’ভারতীয় গুপ্তচর সংস্থার অজানা অধ্যায়, (বাংলা অনুবাদ) অনুবাদ,লেঃ (অবঃ) আবু রুশদ রুমী প্রকাশনী
  • আবুল মনসুর আহম্মদ,১৯৮৯;আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর,পঞ্চম সংস্করণ,সৃজন প্রকাশনী লিমিটেড,করিম চেম্বার ৫ম তলা,৯৯ মতিঝিল বাণিজ্যিক এলাকা,ঢাকা ১০০০
  • সাহিদা বেগম,২০০০;আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা:প্রাসঙ্গিক দলিলপত্র,বাংলা একাডেমী, ঢাকা
  • Asoka Raina, Inside RAW: The Story of Indian Secret Service
  • Anthony Mascarenhas, Bangladesh: A legacy of Blood
  • Nayar, Kuldip; 1972; in Himmat, New Delhi, 26th March, 1972.
  • Chowdhury, Abdul Mu’min; 2005: The Creation of Bangladesh -an article in Authentic Voice of South Asia, London Institute of South Asia, 15 The Hamlet, Champion Hill, London SE5 8AW.
  • Viceroy’s Ninth Miscellanous Meeting, 1 May 1947, Maountbatten Papers, File No. 196.
  • G. Casey to Viscount Wavell, 17 December 1944 in N. Mansergh et al. Transfer of Power, London, 1970.

 

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *