অধ্যায় আঠাশ: শেখ মুজিবের অপরাধনামা

অপরাধ মানবহত্যার

শেখ মুজিবকে একবার একই টেবিলে সামনা-সামনি বসে কিছুক্ষণ তাকে দেখা ও তার মুখের কিছু কথা শোনার সুযোগ হয়েছিল এ লেখকের। সেটি ছিল ১৯৭০’য়ের জানুয়ারীর প্রথম সপ্তাহ; স্থানটি ছিল পুরোন পল্টনে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় অফিসের দো’তালায়। সেখানে সন্ধায় হাজির হয়েছিলাম আমার নিজ এলাকার আওয়ামী লীগের দুই নেতার দৈবাৎ সহচর হয়ে। তাদের একজন ছিলেন আমাদের পারিবারীক চিকিৎসক, সে সূত্রেই তাদের সাথে সেদিন বিকেলে কিছু সময় কাটানো। সেদিন আমাদের তিন জনকেই তিনি চা’ পানে আপ্যায়িত করেছিলেন; চেয়ার থেকে উঠে আমাদের তিনজনের সাথে হাতও মিলিয়েছিলেন। সেখানে দেখলাম নানা নেতাকর্মীদের মূক্ত আনাগোনা। মনে হলো তাদের কেউ কেউ মফস্বলের বিভিন্ন জেলার। সামনে নির্বাচন। নির্বাচনি জনসভাকে সামনে রেখে কেই কেউ জিজ্ঞেস করছেন,তার সফর উপলক্ষে শহরে ক’খানি তোরণ বানানো হবে ইত্যাদি বিষয়। কেউ কেউ নিজ নিজ এলাকায় সম্ভাব্য প্রার্থীদের নিয়ে সুপারিশ করছেন। আমি যাদের সঙ্গি হয়েছিলাম তাদের মতলবটি ছিল এই সুপারিশ। কেউ কেউ তার সাথে বাসায় একান্ত সাক্ষাতের জন্য সময় চাইছেন। সামনে নির্বাচন, ফলে শেখ মুজিবের সাথে তাদের আলোচনার মূল বিষয়গুলো ছিল নির্বাচনী বিষয়াদি।এক ব্যক্তি শেখ মুজিবের বাঁ পাশে দাঁড়িয়ে তাকে খবর দিলেন, জামায়াতে ইসলামীর লোকেরা মফস্বল থেকে ঢাকায় লোক জড়ো করছে। সম্ভবতঃ সে ব্যক্তি ১৮ই জানুয়ারি পল্টনে অনুষ্টিতব্য জামায়াতের জনসভায় লোক সংগ্রেহর দিকে ইঙ্গিত করছিলেন।সে খবর শুনে শেখ মুজিব বেশ উত্তেজিত হলেন এবং যা বল্লেন সেটি কোন সভ্য ও গণতান্ত্রিক চেতনা-সম্পন্ন মানুষের কথা মনে হয়নি। মুখের পাইপ থেকে তামাকের সাদা ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে রাগতঃ স্বরে বল্লেন,“লাহোর-করাচীর ব্যবসায়ীদের টাকা নিয়ে মওদূদী বাঙ্গালী কিনতে আসছে।দেখে নিব কি করে মিটিং করে।” উল্লেখ্য,১৯৭০’য়ের ১৮ই জানুয়ারি পল্টন ময়দানে ছিল জামায়াতে ইসলামীর নির্বাচনী জনসভা।এবং সে মিটিংযে জামায়াত নেতা মাওলানা মওদূদীর বক্তৃতা দেয়ার কথা ছিল।

শেখ মুজিবের কথা শুনে আমি তো অবাক। তিনি বলছেন, মওদূদী বাঙ্গালী কিনতে আসছেন। তা হলে প্রশ্ন হলো, বাঙ্গালী কি তবে গরু-ছাগলের ‌ন্যায় বিক্রয়যোগ্য পণ্য? মুজিবের চোখে এটিই কি বাঙালীর মূল্যায়ন?  তাছাড়া তিনি কি করে বলেন, “দেখে নিব কি করে মিটিং করে?” এটি কি গণতন্ত্রের ভাষা? মাওলানা মওদূদী পাকিস্তানের একটি রাজনৈতিক দলের নেতা।দেশের যে কোন স্থানে জনসভা করার অধিকারটি তাঁর নাগরিক অধিকার।সে অধিকারকে খর্ব করার কোন অধিকার শেখ মুজিবের ছিল না। সেটি তো শাস্তিযোগ্য ফৌজদারি অপরাধ।বাঙ্গালী কেনাই যদি মাওলানা মওদূদীর পরিকল্পনা হয় তবে সেটির মোকাবেলা রাজনৈতিক ভাবে করা উচিত।কিন্তু সে অভিযোগ এনে পল্টন ময়দানে মাওলানা মওদূদীকে মিটিং করতে দেয়া হবে না -এটি কোন ধরণের বিচার? এটি তো নিরেট ফ্যাসীবাদ। এভাবে জনসভা বানচাল করা কি কোন সভ্য দেশে শোভা পায়? সে তরুন বয়সেই মনে হয়েছিল দেশটির সামনে ভয়ানক দুর্দিন। কারণ, মানব ইতিহাসের বড় বড় বীভংস গণহত্যাগুলো বাঘ-ভালুকদের ন্যায় হিংস্র পশুদের হাতে হয়নি; হয়েছে হিটলারের ন্যায় ফ্যসিবাদি দানবদের হাতে। যে কোন সমাজে এরূপ ফ্যাসিবাদীগণই হলো সবচেয়ে হিংস্র জীব। তখনই মনে হয়েছিল, শেখ মুজিব দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ, জামায়াতে ইসলামীকে শুধু পল্টনে নয়, দেশের কোথাও কোন শান্তিপূর্ণ মিটিংই করতে দিবেন না। মুজিব তার সিদ্ধান্তে অটল ছিলেন। মাওলানা মওদূদী পল্টনে বক্তৃতা দিতে পারেননি। সেদিন জামায়াতে ইসলামীর জনসভাকে সত্যই পণ্ড করা হয়েছিল। তবে অতি নিষ্ঠুরতার সাথে। জনসভা বানচাল করতে দুই জনকে হত্যা করা হয় এবং আহত করা হয় বহুশত নিরীহ মানুষকে। পল্টনের ময়দানের জনসভায় ঐদিন হাজির হওয়া ছাড়া তারা আর কোন অপরাধই করেনি। সে নিরপরাধ মানুষের খুনের বিচার সেদিন হয়নি। মুজিবকে তাই কাঠগড়ায় উঠতে হয়নি। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এ দুইজন নিরপরাধ ব্যক্তির খুন ও শত শত ব্যক্তির আহত করার অপরাধ থেকে কি মুজিব আখেরাতে নিস্কৃতি পাবেন? মুজিবের ফ্যাসিবাদ এতটাই নিষ্ঠুর ছিল যে, শুধু জামায়াতে ইসলামীকে নয়, অন্য কোন দলকেও তিনি পল্টন ময়দানে জনসভা করতে দেননি। বন্দী অবস্থায় সিরাজ শিকদারকে হত্যার পর তিনি সংসদে দাঁড়িয়ে গর্বভরে বলেছিলেন, “কোথায় আজ  সিরাজ শিকদার?” প্রতিটি বিচার-বহির্ভুত হত্যাই সন্ত্রাস। সভ্য দেশে এরূপ মানব হত্যার কাণ্ডগুলো ঘটায় বনের হিংস্র পশু, ঘাতক ডাকাত, পেশাদার খুনি ও গুপ্ত দলের সন্ত্রাসীগণ। কিন্তু স্বৈরাচারি সরকারের হাতে এরূপ হত্যা ও সন্ত্রাস রাষ্ট্রীয় নীতিতে পরিণত হয়। স্বৈরাচারী শাসনের এটিই হলো সবচেয়ে নিষ্ঠুর অনিষ্টতা। তখন দেশের পুলিশ, প্রশাসন, সেনাবাহিনী এবং আদালতের বিচারকগণও সে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের একনিষ্ঠ হাতিয়ারে পরিণত হয়। আওয়ামী লীগের শাসনামলে প্রতিবারেই এমন বর্বরতা চেপে বসেছে বাঙালীর ঘাড়ে। হিটলারের হাতে ছিল গ্যাস চেম্বার ও ঘাতক পুলিশ, মুজিবের হাতে ছিল রক্ষিবাহিনী ও দলীয়  ক্যাডার। তাই শেখ মুজিবের স্বৈরাচারি শাসনামলে সিরাজ শিকদারের বিচারবহিরর্ভুত হত্যাই একমাত্র সন্ত্রাসী খুন ছিল না। বরং সেটিই তার শাসনের নীতিতে পরিণত হয়। তাই মুজিবের অপরাধ, তিনি শুধু গণতন্ত্রই হত্যা করেননি, রক্ষিবাহিনী দিয়ে ৩০ হাজারের বেশী রাজনৈতিক নেতাকর্মীকে হত্যা করেছেন। পুলিশ ও আদালতের বিচারকগণ তখন জনগণের রক্ষকের বদলে সেসব রাষ্ট্রীয় খুনের নিরব দর্শকে পরিণত হয়েছে। মুজিব মারা গেছেন, কিন্তু গুম ও খুনের ন্যায় সন্ত্রাসের সে নিষ্ঠুর সংস্কৃতি মারা যায়নি। বরং প্রবল বিক্রম নিয়ে আজও বেঁচে আছে।

 

অপরাধ মিথ্যাচারীতার

শেখ মুজিবের অপরাধ শুধু মানবহত্যা নয়, বরং তার অপরাধনামাটি বিশাল ও বহুমুখি। পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতিতে তিনি আবির্ভূত হয়েছিলেন হ্যামিলিয়নের বংশীবাদক রূপে। দেশবাসীকে নানা ভাবে প্রলুদ্ধ করে তিনি নিজের পিছনে টেনেছেন। প্রলোভন দেখিয়েছেন স্বাধীন সোনার বাংলার, কিন্তু গলায় পড়িয়েছেন ভারতীয় গোলামীর শিকল। ওয়াদা দিয়েছেন বহুদলীয় গণতন্ত্রের, কিন্তু প্রতিষ্ঠা করেছেন একদলীয় বাকশালী স্বৈরাচার। বাংলাদেশে আজ যে দুঃসহ স্বৈরাচার, সন্ত্রাস, গুপ্তহত্যা ও দূর্নীতি -সেটি মূলত মুজিবামলেরই লিগ্যাসি। প্রথমে স্বায়ত্বশাসন প্রতিষ্ঠা ও পরে পাকিস্তান ভাঙ্গার আন্দোলনে শেখ মুজিব তার আসল চরিত্র বহুলাংশে লুকিয়ে রাখতে পারলেও সেটি প্রকাশ পায় বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠার পর। মিথ্যা বলা কবিরা গুনাহ। কিন্তু সে গুনাহর কাজটি যদি নেতৃত্বের মঞ্চ থেকে হয়,তখন সে সংক্রামক রোগটি আর সীমিত থাকে না; তাতে সংক্রামিত হয় সমগ্র দেশ। এতে মিথ্যার পেটে জন্ম নেয় নানারূপ দুবৃত্তি; দেশ তখন দুর্বৃত্তিতে দ্রুত বিশ্বরেকর্ড গড়ে। মুসলিম দেশে নেতার কাজটি তো মিথ্যার নির্মূল ও সত্যের প্রতিষ্ঠা। মহান আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে প্রত্যেকে মুসলিমের জন্য এটি এক সুনির্ধারিত মিশন। এবং সেটি মিশন হয় মুসলিম রাষ্ট্রের প্রতিটি নেতা, প্রতিটি প্রতিষ্ঠান ও প্রতিটি কর্মচারীর। নেতার আসনে বসে মহান নবীজী (সাঃ) তো সে মিশনই পালন করেছেন। মুসলিমের জীবনে রাজনীতি বাধ্যতামূলক শুধু নবীজী (সাঃ)র সে পবিত্র সূন্নত পালনের লক্ষ্যে নয়, বরং অধীক গুরুত্বপূর্ণ একারণে যে, এরূপ রাজনীতির মধ্য দিয়েই পালিত হয় মহান  পক্ষ থেকে নির্দেশিত মিশন। এ পবিত্র মিশন পালনে আগ্রহী না হলে ব্যক্তির জীবনে কখনোই জিহাদ আসে না। ফলে রাষ্ট্রে আল্লাহর দ্বীনও বিজয়ী হয় না।তখন বিজয়ী শয়তানী শক্তির শাসন। বাংলাদেশে তো সেটিই হয়েছে। অথচ মু’মিন ব্যক্তিদের সিসাঢালা দেয়ালের ন্যায় ঐক্যবদ্ধ জিহাদই হলো মহান আল্লাহতায়ালার কাছে সবচেয়ে প্রিয় ইবাদত। -(সুরা সাফ, আয়াত ৪)। নবীজী (সাঃ)র মৃত্যুর পর মুসলিম উম্মাহর রাজনৈতীক নেতৃত্বের আসনে বসেছেন মহান সাহাবীগণ। সে আসনে কখনোই ভণ্ড তথা মুনাফিকদের বসতে দেয়া হয়নি। অথচ বাংলাদেশের ন্যায় একটি সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম দেশে সে মহান মিশন ও নবীজী (সাঃ)র সে পবিত্র সূন্নত পালিত হয়নি। বরং রাজনীতির পবিত্র অঙ্গন অধিকৃত হয়েছে ইসলামের চিহ্নিত শত্রুশক্তির হাতে। ইসলাম ও ইসলামের শরিয়তী বিধানের প্রতিষ্ঠার রাজনীতিকে তারা সাম্প্রদায়িকতা বলে; এবং ইসলামী বিধানকে পরাজিত করা ও পরাজিত রাখার সে রাজনীতির প্রধানতম নেতা ছিলেন শেখ মুজিব। ফলে মহান আল্লাহতায়ালা ও তাঁর মনোনীত দ্বীনের বিরুদ্ধে মুজিবের অপরাধের মাত্রাটি গুরুতর। আর সে অপরাধের রাজনীতি অব্যাহত রেখেছে মুজিব কন্যা শেখ হাসিনা।

১৯৭০ সালের ৭ই ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত হয়েছিল পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের নির্বাচন। সে নির্বাচনের প্রাক্কালে শেখ মুজির ২৮শে অক্টোবর জাতির উদ্দেশ্যে রেডিও ও টিভি ভাষণ দেন। সে ভাষণে তিনি বহু অসত্য কথা বলেন। তার প্রদত্ত বক্তৃতা থেকে তেমন একটি মিথ্যার নমুনাঃ “তদানীন্তন ক্ষমতাসীন দল (পাকিস্তান মুসলিম লীগ) সমগ্র দেশকে একদলীয় রাষ্ট্রে পরিণত করার যে প্রচেষ্টা চালিয়েছিল, সেই হীন প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর জন্যই আমাদের মহান নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠিত হয়। এ ভাবেই আমরা পাকিস্তানে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আপোষহীন সংগ্রাম শুরু করি।”-(২৯ অক্টোবর ১৯৭০, দৈনিক পাকিস্তান, ঢাকা)। এ তথ্যটি ছিল সম্পূর্ণ মিথ্যা। সত্য হলো, পাকিস্তান মুসলিম লীগ কখনোই দেশকে একদলীয় রাষ্ট্র করার চেষ্টা করেনি। তার প্রমাণ, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার মাত্র কয়েক বছরের মধ্যে যখন আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠিত হয় তখন মুসলিম লীগ সরকারের পক্ষ থেকে এই নতুন দলটির প্রতিষ্ঠায় কোন রূপ বাধাই সৃষ্টি করা হয়নি। দেশটি প্রতিষ্ঠা পাওয়ার পর যে গণ-পরিষদ তথা পার্লামেন্ট গঠন করা হয় তার সদস্যরা নির্বাচিত হয়েছিলেন ব্রিটিশ সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত ১৯৪৬ সালের নির্বাচনে। সে গণপরিষদ থেকে কংগ্রেস দলীয় সদস্যদের সদস্যপদ হরণ করা হয়নি। বহুদলীয় রাজনীতি চলেছে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব ও প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের আমলেও।

পাকিস্তান কোন কালেই একদলীয় রাষ্ট্র ছিল না। সে দেশের কোন গণতান্ত্রিক সরকার দূরে থাক, এমন কি কোন সামরিক সরকারও এমন সিদ্ধান্ত নেয়নি। শুধু আওয়ামী লীগ কেন, আরো বহু দল আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠার পূর্ব থেকেই পাকিস্তানে কাজ করছিল। এমন কি যে কংগ্রেস পাকিস্তান সৃষ্টির প্রচণ্ড বিরোধীতা করেছিল সে দলটিরও সংসদে স্বাধীন ভাবে কাজ করার পূর্ণ অনুমতি ছিল। সংসদে এ দলটিরও বহু সদস্য ছিল। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর খোদ আওয়ামী লীগও সে বহুদলীয় রাজনীতি থেকে পুরা ফায়দা নিয়েছে। ১৯৫৪ সালে মুসলিম লীগের শাসনামলে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়,সেটিই ছিল পূর্ব বাংলার ইতিহাসে সবচেয়ে অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন। মুসলিম লীগ সে নির্বাচনে প্রচণ্ড ভাবে হেরে গিয়ে প্রমাণ করেছিল, তারা নির্বাচনী ফলাফলকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করেনি। সে ধরনের নির্বাচন অনুষ্ঠানের সুযোগ আওয়ামী লীগ তাদের শাসনামলে কোন কালেই দেয়নি। একদলীয় রাজনীতির শুরু পাকিস্তান ভেঙ্গে যাওয়ার পর এবং সেটি বাংলাদেশে। সেটিও স্বয়ং শেখ মুজিবের হাতে। এবং সেটি বাংলাদেশ কৃষিক শ্রমিক আওয়ামী লীগ, সংক্ষেপে বাকশাল প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে। ফলে প্রমাণ মেলে, শেখ মুজিব ১৯৭০’য়ের নির্বাচনী প্রচারণাটি শুরু করেছিলেন ডাহা মিথ্যা কথা রটনার মধ্য দিয়ে।

বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর শেখ মুজিব আবির্ভূত হন একজন স্বৈরাচারী ফ্যাসীবাদী নেতা রূপে। শুধু বাংলাদেশের ইতিহাসেই নয়, সমগ্র উপমহাদেশের ইতিহাসে তিনিই প্রথম নেতা যিনি একদলীয় শাসনের ঘোষণা দেন। এমন স্বৈরাচারী পদ্ধতির প্রতিষ্ঠা পাকিস্তানে যেমন কোন কালে হয়নি; ভারত, শ্রীলংকা ও নেপালেও হয়নি। খোদ আওয়ামী লীগের উপর প্রতিষ্ঠিত হয় মুজিবের একচ্ছত্র আধিপত্য। শেখ মুজিরেব হাতে সর্বময় ক্ষমতা তুলে দেয়ার স্বার্থেই ১৯৭৫ সালের ২৫শে জানুযারিতে শাসনতন্ত্রে আনা হয় সংশোধনী। মাত্র ১১ মিনিটের মধ্যে ২৯৪জন পার্লামেন্ট সদস্যের ভোটে পার্লামেন্টারী পদ্ধতির সরকার রূপান্তরিত হয় প্রেসিডেন্সিয়াল ফরমে। জনগণের ভোট ছাড়াই শেখ মুজিব উক্ত দলীয় পার্লামেন্টের ভোটে ৫ বৎসরের জন্য অর্থাৎ ১৯৮০ সাল অবধি নিরঙ্কুশ ক্ষমতার অধিকারি প্রেসিডেন্ট রূপে আবির্ভূত হন। প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচনের জন্য শেখ মুজিব জনতার আদালতে যাওয়ার প্রয়োজনও বোধ করেননি। প্রতিষ্ঠা করেন, দেশের একমাত্র রাজনৈতিক দল বাকশাল। তালা ঝুলিয়ে দেন অন্যান্য দলের দফতরগুলিতে। ফরমান জারি করেন, ১৯৭৫ সালের ২৫শে মে’র মধ্যে সকল সংসদ সদস্যকে বাকশালে যোগ দান করতে হবে নইলে বাতিল ঘোষিত হবে তাদের সংসদ সদস্যপদ। স্রেফ ৫ বা ১০ বছরের জন্য নয়, তার দলীয় সদ্স্যগণ পাকাপোক্ত বন্দোবস্তও করেছিল তাকে আজীবন প্রেসিডেন্ট করার। ১৯৭৫’য়ের ১৫ আগস্ট মারা না গিলে সে রেকর্ডও যে তিনি প্রতিষ্ঠা করতেন -তা নিয়েও কি কোন সন্দেহের অবকাশ আছে? সে লক্ষ্যে তার দলীয় নেতা-কর্মীগণ মাঠে-ময়দানে এক নেতা-এক দেশের ধারণা জোরে শোরে প্রচার করেছিল। যে দলের কর্মীরা শেখ মুজিবকে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালী রূপে বিশ্বাস করে -তারা যে সে সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালীকে আজীবনের জন্য প্রেসিডেন্ট করতে চাইবে -তাতেই বা বিস্ময়ের কি আছে?

বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর দেশটি জন্য বিপদের কারণ স্রেফ শেখ মুজিব একা ছিলেন না। তিনি পরিবেষ্টিত ছিলেন এমন একদল চতুর চাটকরদের হাতে যাদের কারণে দেশের জন্য যে কোন কল্যাণ-কর্মই অসম্ভব হয়ে পড়ে। তাদের মুখে ছিল মুজিবভক্তি;কিন্তু সে মুজিব ভক্তির পিছনে ছিল প্রচণ্ড স্বার্থপরতা। মুজিবকে শাসনক্ষমতায় রেখে তাদের লক্ষ্য ছিল দেশের রাজস্বভাণ্ডার ও বিদেশ থেকে প্রাপ্ত অর্থভাণ্ডারের উপর লুণ্ঠনের অধিকার প্রতিষ্ঠা। সেরূপ লুণ্ঠনের অবকাঠামো গড়ে তুলতে তারা সফলও হয়েছিল।চাটুকারিতা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে, মুজিবকে খুশি করতে তাকে শুধু জাতির পিতা রূপে ঘোষণা দিয়েই খুশি ছিল না।তারা চাচ্ছিল,তাকে বিশ্বের বাজারে ছাড়তে। সমাজবাদ, সাম্যবাদের পাশাপাশি মুজিবের রাজনীতি ও বিশ্বাসকে তারা একটি মতবাদ রূপে খাড়া করে। খন্দোকার ইলিয়াস নামে এক ব্যক্তি মুজিববাদ নামে একখানি বিশাল বইও লিখে ফেলে। শেখ মুজিব তার জীবদ্দশাতে মুজিববাদের যে পরিচিতি খাড়ে করে তা ছিল একদলীয় বাকশালী স্বৈরাচার,ভারতের প্রতি শর্তহীন আনুগত্য,লুণ্ঠনের অর্থনীতি, বিচার বহির্ভুত হত্যা,পাকিস্তান বৈরীতা ও ইসলামের বিরুদ্ধে আক্রোশ।খন্দোকার ইলিয়াসের লেখা মুজিববাদ বই’য়ে পাকিস্তান চিত্রিত হয় ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ ও মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর উগ্র গোঁড়ামী প্রসূত একটি মধ্যযুগীয় বর্বর দেশ রূপে।এবং ইসলাম চিত্রিত হয় সশস্ত্র বিদেশীদের প্রচারিত ধর্ম রূপে।বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাকে দেখানো হয় জিন্নাহর দ্বি-জাতিতত্ত্ব ও ইসলামের নামে রাষ্ট প্রতিষ্ঠার ব্যর্থতার দলিল রূপে।এবং পূর্ব পাকিস্তান চিত্রিত হয় পশ্চিম পাকিস্তানের উপনিবেশ রূপে।-(ইলিয়াস,খন্দকার; ১৯৭২)। তবে সে মুজিবাদ ১৯৭৫ সালে মারা গেলেও, প্রচণ্ড ভাবে তা আবার প্রতিষ্ঠা পেয়েছে হাসিনার ক্ষমতায় আসাতে।

 

অপরাধ ক্ষমতালিপ্সার

অন্যের ন্যায্য অধিকারের উপর স্বৈরাচারী শাসকের কোনরূপ শ্রদ্ধাবোধ থাকে না। সেটি মুজিবেরও ছিল না। স্বৈরাচারী শাসক শুধু তার নিজের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠায় আগ্রহী। অন্যদের থেকে স্বৈরাচারীর প্রত্যাশা, তারা তার একান্ত তাঁবেদার ও চাটুকর হবে। তাই মুজিব গণতান্ত্রিক অধিকার দেননি নিজ দলের নেতাকর্মীদেরও। ফলে গণতন্ত্র শুধু বাংলাদেশেই মারা পড়েনি, মৃত্যুবরণ করেছিল তার নিজের দলের মধ্যেও। আওয়ামী লীগের কোন নেতাই সেদিন শেখ মুজিবের একদলীয় স্বৈরাচারী রাজনীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেনি। নেতা ও কর্মীগণ পরিণত হয়েছিল বিবেকহীন চাটুকারে। গণতন্ত্রের নামে প্রতিষ্ঠিত একটি দল যে কীভাবে অতি দ্রুত একদলীয় ফ্যাসীবাদের দিকে ধাবিত হয় এবং নেতাকর্মীগণ মোসাহেব দুর্বৃত্তে পরিণত হয় -তারই নমুনা পেশ করে আওয়ামী লীগ। মুজিব পরিণত হয় বাংলাদেশের হিটলারে। সেদিন একমাত্র জেনারেল ওসমানী ও ব্যারিস্টার মঈনুল হোসেন -এ দুই ব্যক্তি একদলীয় বাকশালী নীতির বিরোধীতা করে পদত্যাগ করেছিলেন। লক্ষণীয় হলো, এ দু’জনের কেউই আওয়ামী লীগের প্রথম সারির নেতা ছিলেন না। অথচ যারা ছিল আওয়ামী লীগের নিজ ঘরানার প্রবীন নেতাকর্মী এবং গণতন্ত্র নিয়ে যাদের ছিল প্রচণ্ড গলাবাজি -তারা সেদিন সামান্যতম বিবেক বা নৈতিক মেরুদন্ডের প্রমাণ রাখতে পারেনি। সংসদের ২৯৪ জন সদস্যের মাঝে দুইজন বাদে আর কোন ব্যক্তিই সেদিন প্রতিবাদ করেনি। দল থেকে পদত্যাগও করিনি। অথচ গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রতি সামান্যতম অঙ্গীকার থাকলে কোন ব্যক্তি কি এমন একদলীয় শাসনকে সমর্থন করতে পারে? কারণ এটি তো ছিল মানবাধিকার ও বহুদলীয় গণতন্ত্রকে কবরে পাঠানোর মত অপরাধ। অথচ সেদিন আওয়ামী লীগ দলীয় সংসদ সদস্য ও নেতা-কর্মীগণ স্বৈর-শাসনের শুধু সমর্থনই করেননি, সেটির পক্ষে প্রচণ্ড ওকালতিও করেছেন। সেটি নিয়ে সামান্যতম অনুশোচনা দূরে থাক, আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের মাঝে আজও তা নিয়ে প্রচণ্ড অহংকার। গণতান্ত্রিক চেতনাবিবর্জিত মেরুদণ্ডহীন নেতাকর্মী উৎপাদনে দলটি যে কতটা সফল কারখানায় পরিণত হয়েছিল –সেটিই সেদিন প্রমানিত হয়েছিল। এসব মেরুদণ্ডহীন নেতাকর্মীগণ সেদিন দলে দলে উৎসব-ভরে আত্মসমর্পণ করেছিল শেখ মুজিবের একদলীয় স্বৈর-শাসনের কাছে। ছলেবলে ও নানা কৌশলে ক্ষমতা দখল এবং ক্ষমতায় থাকা ছাড়া দলটির যে কোনরূপ মহত্তর লক্ষ নেই -সেটিই সেদিন তারা প্রমাণ করেছিল। গণতন্ত্রের বুলি পরিণত হয়েছিল ক্ষমতায় উঠার সিঁড়ি রূপে। নিজেরা ক্ষমতায় যাওয়ার সাথে সাথে সে সিঁড়িকে দূরে ছুঁড়ে ফেলেছে। স্মরণযোগ্য, পাকিস্তান কোনদিনই ফ্যাসীবাদের কবলে পড়েনি। দেশটিতে বহুদলীয় রাজনীতি ছিল, বহু বিরোধী দলীয় পত্রিকাও ছিল। পাকিস্তানের প্রচণ্ড শত্রু  ও ভারতের প্রমানিত চর হওয়া সত্ত্বেও শেখ মুজিবসহ কোন আওয়ামী লীগের কোন নেতাকে ফাঁসীতে ঝুলতে হয়নি। অথচ বাংলাদেশে বহুদলীয় রাজনীতির কবর রচিত হলো এবং সেটি আওয়ামী লীগ ও তার নেতা শেখ মুজিবের হাতে। দেশ পরিণত হয় পুলিশী রাষ্ট্রে। সেদিন নিষিদ্ধ হয়েছিল সকল বিরোধী পত্রিকা। প্রকাশনের অধিকার পেয়েছিল একমাত্র সেসব পত্রিকা যেগুলি মুজিব-বন্দনাকে নিজেদের ব্রত রূপে গ্রহণ করেছিল। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান আওয়ামী লীগ ও তার নেতা শেখ মুজিবকে যে গণতান্ত্রিক অধিকার দিয়েছিল সেটি শেখ মুজিব ও তার দল নিষ্ঠুর ভাবে কেড়ে নিয়েছিল বাংলাদেশীদের থেকে । একদলীয় বাকশাল প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে তিনি গণতন্ত্রকে পাঠিয়েছিলেন কবরস্থানে। দেখা যাক, মুজিব সম্বন্ধে তার অতি কাছের লোকেরা কি বলেনঃ “১১ই জানুয়ারি (১৯৭২) টেলিফোন বাজিয়া উঠিল। রিসিভার তুলিয়া একটি পরিচিত কিন্তু অত্যন্ত অপ্রত্যাশিত কন্ঠস্বর শুনিতে পাইলাম। কন্ঠস্বরটি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদের। কলেজ জীবন হইতে বন্ধূ;..টেলিফোনে তাজউদ্দিন কুশলাদি জিজ্ঞাসার পর আমাকে বলেন, “শেখ সাহেবকে প্রধানমন্ত্রী পদে আসীন করিবার সিদ্ধান্ত লইয়াছি এবং প্রস্তাবও করিয়াছি। কারণ তিনি যে কোন পদেই বহাল থাকুন না কেন, তাঁহার ইচ্ছা-অনিচ্ছাতেই রাষ্ট্রীয় প্রশাসন পরিচালিত হইবে। শেখ সাহেবের মানসিক গড়ন তুমিও জান; আমিও জানি। তিনি সর্বাত্মক নিয়ন্ত্রণে অভ্যস্থ্। অতএব ক্ষণিকের ভুল সিদ্ধান্তের জন্য পার্লামেন্টারী কেবিনেট পদ্ধতির প্রশাসন প্রহসনে পরিণত হইবে। তিনি প্রেসিডেন্ট পদে আসীন থাকিলে নিয়মান্ত্রিক নাম-মাত্র দায়িত্ব পালন না করিয়া মনের অজান্তে কার্যতঃ ইহাকে প্রেসিডেন্ট পদ্ধতির প্রশাসনে পরিণত করিবেন। এই দিকে প্রেসিডেন্ট পদে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীকে নির্বাচনের কথা ভাবিতেছি। তোমার মত কি?” তদুত্তরে তাঁহাকে বলি, “তোমার সিদ্ধান্ত সঠিক। নামমাত্র প্রেসিডেন্টের ভূমিকা পালন শেখ সাহেবের শুধু চরিত্র বিরুদ্ধ হইবে না; বরং উহা হইবে অভিনয় বিশেষ। কেননা,ক্ষমতার লোভ তাঁহার সহজাত।” তাজউদ্দিন টেলিফোনের অপর প্রান্তে সশব্দে হাসিয়া উঠিলেন। বলিলেন, “আমি জানিতাম, মৌলিক প্রশ্নে তোমার আমার মধ্যে মতভেদ হইবে না।” -(অলি আহাদ)। উল্লেখ্য,জনাব অলি আহাদ ছিলেন পঞ্চাশের দশকে পূর্ব-পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক। সে সময় শেখ মুজিব ছিলেন দলটির সাধারণ সম্পাদক।

 

চরিত্রধ্বংসী নাশকতা

নিরঙ্কুশ ক্ষমতা দখলই ছিল শেখ মুজিবের প্রধান খায়েশ -তা নিয়ে এমন কি তাজউদ্দিন আহমদেরও কোন সন্দেহ ছিল না। ক্ষমতার নেশায় তিনি কখনো প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন, কখনো প্রেসিডেন্ট হয়েছেন। কখনো বা জরুরী আইন জারি করে জনগণের সকল নাগরিক অধিকার কেড়ে নিয়েছেন এবং সকল ক্ষমতা কুক্ষিগত করেছেন। শেষের দিকে এসে সকল বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলিকে নিষিদ্ধ করেন। নির্দ্বিধায় হরণ করেন বাক স্বাধীনতা। একমাত্র সামরিক ক্ষমতা বলে অপসারণ ছাড়া রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের আর কোন পথই তিনি খোলা রাখেননি। অবশেষে সে পথেই তাকে বিদায় নিতে হয়েছিল। এই হলো তার রাজনৈতিক জীবন। কথা হলো, এ ক্ষমতালোভী ও স্বৈরাচারী রাজনীতি কি কোন সভ্য দেশের ও সভ্য মানুষের জন্য মডেল হতে পারে? অথচ বাংলাদেশের আওয়ামী-বাকশালী মহলটি মুজিবের সে স্বৈরাচারী রাজনীতি নিয়েই গর্বিত। তাদের দৃষ্টিতে শেখ মুজিবই সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালী। সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালীর সে রাজনীতি কি তাই কবরে রাখা যায়? তাই শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসায় পর সে মুজিবী রাজনীতির মডেলই বাংলাদেশে প্রবল ভাবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে।

যুগে যুগে স্বৈরাচারী শাসকদের চাটুকার মোসাহেবদের আচরণ অবিকল এমনটিই ছিল। এজন্য স্বৈরাচারী শাসকদের অতি মানব বা মহামানব হওয়ার প্রয়োজন পড়েনি। যুগে যুগে দস্যু চরিত্রের বহু নৃশংস মানুষও চাটুকারদের থেকে শ্রদ্ধা পেয়েছে, এমনকি পূজাও পেয়েছে। দুর্বৃত্ত ফিরাউনকে তো তার তাঁবেদার প্রজারা ভগবান মনে করতো। খোদার আসনে বসিয়ে তাকে শুধু আনুগত্য ও রাজস্বই দিত না, প্রাণও দিত। তারাই তার স্মৃতিকে স্মরণীয় করতে বছরের পর বছর ধরে বিপুল অর্থ ব্যয়ে ও বহু প্রাণের বিনিময়ে পিরামিড নির্মাণ করেছিল। অথচ এরাই হযরত মুসা (আঃ)র মত মানব ইতিহাসের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মানুষ ও মহান রাসূলকে অশান্তি ও গোলযোগ সৃষ্টিকারি মনে করতো। তাঁর হত্যা কল্পে ফিরাউনের নেতৃত্বে তারা সাগর পর্যন্ত ধেয়ে গিয়েছিল। অবশেষে মহান আল্লাহতায়ালা এ দুর্বৃত্ত ফিরাউন ও তার সাথীদের সমুদ্রে ডুবিয়ে হত্যা করেছিলেন। হিটলারকেও তার ভক্তরা সর্বকালের শ্রেষ্ঠ জার্মান মনে করতো। তার হুকুমে তারা লাখে লাখে প্রাণ দিয়েছে। মানুষ যখন মহান আল্লাহতায়ালা প্রদত্ত জ্ঞানে অজ্ঞ ও ঈমানশূন্য হয়, তখন তার আচরণ যে কতটা বিস্ময়কর ভাবে নীচে নামতে পারে সে উদাহরণ তো ইতিহাসে প্রচুর। মানুষ কেন, মানবেতর সাপ-শকুন-গরু-বাছুরকেও এসব জাহেলেরা তখন দেবতার আসনে বসায়। সাপ-শকুন-গরু-বাছুরের তুলনায় ফিরাউন, হিটলারেরা তো অনেক শক্তিধর ছিল। তারা বড় বড় যুদ্ধ জয় করেছে, লক্ষ লক্ষ মানুষের হত্যায় প্রচণ্ড সামর্থ্য দেখিয়েছে এবং বড় বড় রাষ্ট্রও নির্মাণ করেছে। তাই যারা আজ শেখ মুজিবকে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালী বলে, তাদের আচরণেও কি বিস্ময়ের কিছু আছে? কোন সমাজ ও রাষ্ট্রেই দুর্বৃত্ত শাসকগণ একাকী কাজ করেনা। তাদের হাতে দুর্বৃত্তকরণের বিশাল ইন্ডাস্ট্রীও থাকে। সেটি যেমন ফিরাউন ও হিটলারে ছিল, তেমনি শেখ মুজিবেরও ছিল। বস্তুত আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ পরিণত হয়েছে সেরূপ নীতি ও নৈতিকতাবিনাশী ইন্ডাস্ট্রীতে। এখন সে ইন্ডাস্ট্রীর পরিসর শুধু আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগে সীমিত নয়; তাতে শামিল হয়েছে পুলিশ, প্রশাসন, আইন-আদালত, মিডিয়া, সেনাবাহিনীর লোকেরাও। একাত্তরে তাদের হামলার মুখে পড়েছিল অবাঙালী ও পাকিস্তানপন্থিরা, আর এখন খুন, গুম ও নির্যাতনের শিকার হচ্ছে তারাও যারা একাত্তরে বাংলাদেশ সৃষ্টিতে সক্রিয় ছিল।

 

অধিকৃত হলো দেশ

দেখা যাক, কীরূপ ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা নিয়ে শেখ মুজিবের নিজের ধারণা। একাত্তরে ৯ মাস যুদ্ধচলা কালে অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট নজরুল ইসলাম ও প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দিনের মুজিব নগর সরকার ছিল ভারতের আশ্রীত সরকার। এমন সরকারের কোন মেরুদণ্ড থাকে না। জনাব তাজউদ্দিন ও তার মন্ত্রীদের প্রতিদিনের থাকা, খাওয়া-দাওয়া ও ভরন-পোষনের সমুদয় ব্যয় বহন করতো দিল্লীর ইন্দিরা গান্ধী সরকার। খাঁচার পাখির নিজে শিকার ধরার সামর্থ্য থাকে না, মনিব যা দেয় তাই তাকে খেতে হয়। মনিবের মন জোগাতে তখন তার শেখানো বুলিও তখন গাইতে হয়। তাজউদ্দিন সরকারের অবস্থাও তাই ছিল। ফলে তাকে দিয়ে ভারত সরকারও খুশী মত চুক্তিও সই করিয়ে নেয়। কোন স্বাধীন দেশ এমন চুক্তি কখনও স্বাক্ষর করে না। তাজউদ্দিনের স্বাক্ষরিত ৭ দফা চুক্তিনামাটি ছিল নিম্নরূপঃ

১).ভারতীয় সমরবিদদের তত্ত্বাবধানে বাংলাদেশে আধা সামরিক বাহিনী গঠন করা হইবে। গুরুত্বের দিক হইতে এবং অস্ত্রশস্ত্রে ও সংখ্যায় এই বাহিনী বাংলাদেশের মূল সামরিক বাহিনী হইতে বড় ও তাৎপর্যপূর্ণ হইবে। (পরবর্তীকালে এ চুক্তির আলোকে রক্ষী বাহিনী গড়া হয়)।

২).ভারত হইতে সমরোপকরণ অস্ত্রশস্ত্র ক্রয় করিতে হইবে এবং ভারতীয় সমরবিদদের পরামর্শানুযায়ী তাহা করিতে হইবে।

৩).ভারতীয় পরামর্শেই বাংলাদেশের বহিঃবাণিজ্য কর্মসূচী নির্ধারণ করিতে হইবে।

৪).বাংলাদেশের বাৎসরিক ও পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা ভারতীয় পরিকল্পনার সহিত সামঞ্জস্যপূর্ণ হইতে হইবে।

৫).বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি ভারতীয় পররাষ্ট্রনীতির অনুরূপ হইতে হইবে।

৬).ভারত-বাংলাদেশ চুক্তিগুলি ভারতীয় সম্মতি ব্যতীত বাতিল করা যাইবে না।

৭).ডিসেম্বরে পাক-ভারত যুদ্ধের পূর্বে স্বাক্ষরিত চুক্তি অনুযায়ী ভারত যে কোন সময় যে কোন সংখ্যায় বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করিতে পারিবে।

 

উপরে বর্ণিত চুক্তিগুলিতে মুজিব নগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন স্বাক্ষর করেন। -(অলি আহাদ)। কিন্তু তাজউদ্দিনের বদলে যখন শেখ মুজিব ক্ষমতা হাতে নিন তখনও কি ভারতের প্রতি এ নতজানু নীতিতে সামান্য পরিবর্তন এসেছিল? আসেনি। তাজউদ্দিন যে দাসখতে স্বাক্ষর করেছিলেন সেগুলো শেখ মুজিবও মেনে নেন। “১৯৭২ সালের ১৯ মার্চ ঢাকার বুকে বঙ্গভবনে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবর রহমান স্বাক্ষরিত ২৫ সালা বন্ধুত্ব সহযোগিতা ও শান্তি চুক্তিতে সেগুলি সন্নিবেশিত করা হয়।” -(অলি আহাদ)। এভাবেই অধিকৃত হয় বাংলাদেশ। অথচ আওয়ামী লীগ এ ভারতীয় অধিকৃতিকেই বলছে স্বাধীনতা।

 

অর্থনৈতিক নাশকতা

পাকিস্তান আমলে শেখ মুজিব বড় বড় অর্থনৈতিক কল্যাণের কথা বলেছেন। স্বপ্ন দেখিয়েছেন সোনার বাংলার। কিন্তু বাস্তবে তিনি ও তার দল কি করেছে সেটি দেখা যাক। প্রতিটি দেশের দেশপ্রেমিক সরকার শুধু দেশবাসীকে বিদেশী শক্তির সামরিক আগ্রাসন থেকেই রক্ষা করে না, রক্ষা করে সর্বপ্রকার অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক হামলা থেকেও। প্রতি দেশের প্রতিটি দেশপ্রেমিক সরকারই এমন একটি অঙ্গীকার নিয়েই সেদেশে কঠোর ভাবে দিবারাত্র সীমান্ত পাহারা দেয়, যাতে বিদেশী পণ্যের হাতে দেশী পণ্যগুলো বাজার না হারায়। একাজটি যাতে সুচারু ভাবে হয় সে জন্য প্রতিটি দেশপ্রেমিক সরকারই বিপুল অর্থ ব্যয়ে সীমান্ত রক্ষি বাহিনী গড়ে তোলে। এক্ষেত্রে আপোষ চলে না। সামরিক প্রতিরক্ষার চেয়ে অর্থনৈতিক প্রতিরক্ষার বিষয়টি কোন দেশের জন্যই কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। গুরুত্বহীন ছিল না বাংলাদেশের জন্যও। কারণ, নিজ দেশের পণ্য বাজার হারালে সে পণ্যের উৎপাদনকারি শ্রমিকগণ তখন বেকার হয়। এজন্যই প্রতিদেশের দেশ-প্রেমিক সরকার শুধু নিজদেশে নয়, বিপুল উদ্যোগে বিদেশেও বাজার খোঁজে। একাজে ব্যর্থ হলে ভিখারি হওয়া ছাড়া অন্য উপায় থাকে না। মুজিব আমলে বাংলাদেশের ভাগ্যে সেটিই জুটেছিল। এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজে মুজিবের রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও অঙ্গীকার ছিল না। বাংলাদেশীদের বিরুদ্ধে মুজিবের গুরুতর অপরাধ তাই অর্থনৈতিক নাশকতা এবং জনগণকে ভাতে মারার। সে নাশকতার ফলে বিশ্বের ষষ্ঠ বৃহত্তম রাষ্ট্র বাংলাদেশ বিশ্বজুড়ে পরিচিতি পেয়েছিল “তলাহীন ভিক্ষার ঝুলি” রূপে। মুজির আমলের এটিই ছিল সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য অর্জন। আগামী বহু শত বছর ধরে বাংলাদেশের মানুষকে এ বদনামের বোঝা ও কলংক বইতে হবে। অথচ দেশটির অতীত ইতিহাসে এরূপ পরিচয় কোনকালেই ছিল না। বরং বাংলার মসলিন শিল্প তখন বাজার পেয়েছে বিশ্বের নানা জনপদে।

ভারত শুরু থেকেই চাচ্ছিল, বাংলাদেশের স্বাধীন রাজনৈতিক ভূগোল বিলুপ্ত করা। সে লক্ষ্যটি ১৯৪৭ সাল থেকেই। সেটি সম্ভব না হলে অন্তত অর্থনৈতিক সীমান্ত বিলুপ্ত করা -যাতে ভারতীয় পণ্য বাংলাদেশের বাজারে অবাধে প্রবেশাধিকার পায়। এটি ছিল ভারতীয় বিদেশ নীতির গুরুত্বপূর্ণ স্ট্রাটেজী। আর এ লক্ষ্যে ভারতকে বেশী দিন অপেক্ষা করতে হয়নি। পাকিস্তান থেকে শেখ মুজিবের ফিরে আসার তিন মাসের মধ্যে ভারত সে অধিকার আদায় করে নেয়। রাজনৈতিক, সামরিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থ সংরক্ষণে একটি দেশের দেশপ্রেমিক সরকারের যে প্রবল রাজনৈতিক অঙ্গীকার থাকে, সেটি শেখ মুজিব ও তার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের ছিল না। ভারত ১৯৭২ সালের ২৭ই মার্চ মুজিব সরকারের সাথে সীমান্তের ২০ মাইল অবাধ বাণিজ্য চুক্তি সম্পাদন করে। আর এ চুক্তি মোতাবেক ভারতীয় পণ্যের জন্য সমগ্র সীমান্ত খুলে দেন। ফলে ভারত অনায়াসেই পায় বৃহৎ বাজার। ভারত পূর্ব পাকিস্তানেরও প্রতিবেশী ছিল। কিন্তু অখণ্ড পাকিস্তান তার ২৩ বছরে একটি দিনের জন্যও ভারতীয় পণ্যের জন্য সীমান্ত খুলে দেয়নি। প্রতি বছর শত শত কোটি টাকা খরচ করে পাকিস্তান সরকার সীমান্ত পাহারা দিয়েছে যাতে নিজ দেশের পণ্য বিদেশী হামলার মুখে না পড়ে এবং নিরাপত্তা পায় নিরাপদে বেড়ে উঠার। ফলে সে আমলে ভারতের চেয়ে দ্রুত গতিতে শিল্পোন্নয়ন হয়েছে পাকিস্তানে। দ্রুত বেড়েছে কুঠির শিল্প। তখন বিড়ি তৈরী করেই লক্ষ লক্ষ মানুষ জীবিকা নির্বাহ করত। ব্যাপক ভাবে বেড়েছিল তাঁতশিল্প। অথচ মুজিব সে নিরাপত্তা দিতে পারেনি দেশের ক্ষুদ্র শিল্পকে। ফলে দ্রুত ধ্বস নেমেছে দেশের অর্থনীতিতে। দেশের কলকারখানা একের পর বন্ধ হয়েছে এবং ধ্বংস হয়েছে কুটির শিল্প। সরকার কাজ করেছে শুধু দেশের বাজার ভারতীয় পণ্যের জন্য মুক্ত করার লক্ষ্যে, দেশী শিল্প বাঁচাতে নয়। ফলে লক্ষ লক্ষ মানুষ বেকার হয়েছে। নেমে এসেছে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ। অনাহারে প্রাণ হারিয়েছে বহু লক্ষ মানুষ। শুধু নিজের গদীর স্বার্থে এবং ভারতকে খুশি করতে শেখ মুজিব লক্ষ লক্ষ বাংলাদেশীর জীবনে ভয়ানক দুর্যোগ ও মৃত্যু ডেকে আনে। এরূপ নাশকতা মূলক অপরাধের কারণে যে কোন সভ্য দেশেই মুজিবের বিচার হতো।

মুজিবের গুরুতর অপরাধ, তিনি শুধু স্বৈরাচারি শাসন উপহার দেননি, লক্ষ লক্ষ বাংলাদেশীর জীবনে তিনি নির্মম মৃত্যু ডেকে এনেছেন। ১৯৭৩-৭৪ সালের ভয়ানক দুর্ভিক্ষটি ছিল একান্তই তার নিজের সৃষ্টি। আর সেটি পরিকল্পিত ভাবে দেশের তলা ধ্বসিয়ে দিয়ে। পাত্রের তলায় ফুটো থাকলে পাত্রের মালামাল বেড়িয়ে যায়, তবে তা বেশী দূর যায় না। আশে পাশের জায়গায় গিয়ে পড়ে। তেমনি বাংলাদেশের তলা দিয়ে বেড়িয়ে যাওয়া সম্পদ হাজার মাইল দূরের কোন ভিন্ দেশে গিয়ে উঠেনি, উঠেছিল প্রতিবেশী ভারতে। আর এ ফুটো সৃষ্টিতে ভারতীয় ষড়যন্ত্রের কথা কি অস্বীকার করা যায়? পাকিস্তান আমলের ২৩ বছরে পাকিস্তান সরকারের সবচেয়ে বড় কাজটি ছিল, সীমান্ত দিয়ে চোরাকারবারী বন্ধ করা। পাত্রে পানি ধরে রাখতে হলে তাতে ফুটো থাকলে চলে না। তেমনি দেশে সম্পদ ধরে রাখতে হলে সীমান্ত বন্ধ করা ছাড়া বিকল্প নেই। পাকিস্তান সরকার এ কাজে প্রয়োজনে পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যদের বসাতো। কারণ বাঙালী সৈনিকেরা স্থানীয় হওয়ায় চোরাকারবারিদের সাথে সহজেই তারা সহযোগিতা মূলক সম্পর্ক গড়ে তুলতো। অথচ শেখ মুজিব সীমান্ত দিয়ে চোরাকারবারি বন্ধ না করে পুরা সীমান্ত প্রহরাই তুলে নেন।সেটি করেন সীমান্ত বাণিজ্যের নামে। সীমান্ত বাণিজ্যের নামে শেখ মুজিব দেশের তলায় শুধু ফুটো নয়, পুরা তলাটিই ধ্বসিয়ে দিলেন। তলা দিয়ে বাংলাদেশের সম্পদ যেমন ভারতে গিয়ে উঠে,তেমনি ভারতীয় পণ্য বাঁধভাঙ্গা প্লাবনের ন্যায় বাংলাদেশের বাজারে ঢুকতে থাকে। সরকার সে পণ্য থেকে রাজস্ব আদায়েরও সুযোগ পেল না। বিধ্বস্ত হলো দেশী শিল্প ও অর্থনীতি।

সীমান্ত বাণিজ্যের নামে ভারত বাংলাদেশের উপর একটি পরিকল্পিত শোষণ প্রক্রিয়া চাপিয়ে দেয়। ভারত সরকার জানতো, এরূপ সীমান্ত বানিজ্যে লাভ শুধু ভারতেরই হবে, বাংলাদেশের নয়।কারণ, ভারতে বিক্রি করার মত শিল্পজাত পণ্য তখন বাংলাদেশে ছিল না। তাছাড়া বাংলাদেশের শিল্প ক্ষেত্রে তখন নিদারুন দুর্যোগ। পাকিস্তান আমলে যেসব শিল্প-কারখানায় দেশের বাইরে বিক্রি করার মত পণ্য উৎপাদিত হত -তা ইতিমধ্যেই হয় মৃত্যু বরণ করে, অথবা মরণাপন্ন। ফলে সীমান্ত বাজারে যে সব বাংলাদেশী পণ্য বিক্রি হত তা হলো কাঁচা পাট, মাছ, কৃষিপণ্য, বিদেশীদের দেয়া রিলিফের মাল, পাকিস্তান আমলের কাঁসার হাড়ি-পাতিল জাতীয় দ্রব্য। একাত্তরের আগে ভারত সরকার কখনোই পাকিস্তানের কাছে এমন আব্দারের কথা কল্পনাতেও আনতে পারেনি। অথচ মুজিব সেটাই বিনা দ্বিধায় ভারতের হাতে তুলে দেন। ফলে চোরাচালানকারীদের রাতের আঁধারে সীমান্তে নামার প্রয়োজন পড়েনি। দুর্বৃত্তরা তখন পাকিস্তান আমলে প্রতিষ্ঠিত কলকারখানার যন্ত্রাংশ খুলে নামে মাত্র মূল্যে ভারতীয়দের হাতে তুলে দেয়। তলাহীন পাত্র থেকে পানি বেরুতে সময় লাগে না, তেমনি দেশের তলা ধ্বসে যাওয়া সম্পদ বেরিয়ে যেতেও সময় লাগেনি। দেশ তাই দ্রুত সম্পদহীন হয়। তখন ভারত ছিল সমগ্র বিশ্বে সবচেয়ে বড় খাদ্য ঘাটতির দেশ। সে সময় সে দেশটিতে কোটি কোটি মানুষ ভূখা থাকতো। সে অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে বাংলাদেশ থেকে খাদ্যসামগ্রী লুণ্ঠনের নীতি গ্রহণ করে ভারত সরকার। সে লক্ষ্যে ভারত পরিকল্পিত ভাবেই বাংলাদেশের সীমান্তকে চোরাকারবারীদের স্বর্গরাজ্যে পরিণত করে। প্রতিবছর লক্ষ লক্ষ টন খাদ্যশস্য তখন ভারেত চলে যায়। হারিয়ে যায় বিদেশীদের দেয়া রিলিফের মালামালও।  ফলে ত্বরিৎ বেগে ধেয়ে আসে দুর্ভিক্ষ। এভাবে ভারতকে খুশী করতে শেখ মুজিব লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবনে মৃত্যু ডেকে আনে।

১৯৭১’য়ের যুদ্ধজয়ে ভারতের প্রভূত রাজনৈতিক ও সামরিক সুবিধা হয়েছিল। বিশ্বের সর্ববৃহৎ মুসলিম রাষ্ট্র ধ্বংসের মধ্য দিয়ে শুধু যে নিজেরা আনন্দ পেয়েছে তা নয়, গভীর আনন্দ দিয়েছে ইসলামের তাবত দুশমনদের। ভারত তার প্রধানতম প্রতিদ্বন্দীকে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে। বাংলাদেশের বাজার লাভটি ছিল তার সবচেয়ে বড় বিজয়। এটি ছিল ভারতের পশ্চিম বাংলা, বিহার, উড়িষ্যা, ত্রিপুরা ও আসামের সম্মিলিত আভ্যন্তরীন বাজারের চেয়েও বিশাল। এক কালে এর চেয়ে ছোট বাজার দখলে ইংরেজেরা ৫ হাজার মাইল দূর থেকে এ দেশটিতে ছুটে এসেছিল। তবে ভারত শুধু বাজার দখল করেই ক্ষান্ত দেয়নি। বাংলাদেশের পণ্য যাতে নিজ দেশে এবং বহিঃবিশ্বে ভারতীয় পণ্যের বিরুদ্ধে প্রতিযোগিতা না করতে পারে তারও পাকা ব্যবস্থা করেছিল। ইংরেজেরা তাদের পণ্যের বিরুদ্ধে প্রতিযোগিতা নির্মূল করতে বাংলাদেশের মসলিন শিল্পের তাঁতীদের হাত কেটেছিল। তবে ভারত নেয় ভিন্ন পলিসি। শ্রমিকের হাত না কেটে তারা শিকড় কেটেছিল বাংলাদেশের সমুদয় শিল্প ও অর্থনীতির। পুরা শিল্পকেই তারা ধ্বংস করেছিল। সে শিল্প ধ্বংসে ভারতকে পূর্ণ সহযোগিতা দিয়েছিল আওয়ামী লীগের নেতা ও কর্মীবাহিনী। তবে সবচেয়ে বেশী সহযোগিতা দিয়েছিলেন শেখ মুজিব নিজে। ফলে বাংলাদেশের সবচেয়ে লাভজনক আদমজী জুটমিল তখন দেশের সবচেয়ে বড় লোকশানী প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়। অথচ এটি ছিল বিশ্বের সবচেয়ে বড় পাটকল।  নিজ দেশের শিল্প ও অর্থনীতি এভাবে ধ্বংস হলে ভিক্ষাবৃত্তি ছাড়া তখন ভিন্ন পথ থাকে না। মুজিব এভাবেই দেশকে আন্তর্জাতিক ভিক্ষুকে পরিণত করেন। তবে মুজিবের আরো নাশকতা হলো, ভিক্ষার ঝুলির তলাটিও তিনি ধ্বসিয়ে দিয়েছিলেন। বাংলাদেশ বিশ্বব্যাপী তখন পরিচিতি পায় তলাহীন ভিক্ষার ঝুলি রূপে। তলা না থাকায় ভিক্ষার মালও তখন ভারতে গিয়ে পৌঁছে। বাংলাদেশীদের জন্য যা অবশিষ্ঠ থাকে তা হলো অনাহারে মৃত্যু।

 

অপরাধ দুর্বৃত্ত প্রতিপালনের

দেশের শিল্পকারখানা ধ্বংস বা দুর্ভিক্ষে লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবনে মৃত্যু ডেকে আনার পাশাপাশি শেখ মুজিবের অন্য নাশকতাপূর্ণ অপরাধটি হলো চোর-ডাকাত প্রতিপালন ও নৈতীক অবক্ষয় সাধন।দেশের শিল্পকারখানাকে তিনি জাতীয়করণ করেছিলেন। সেগুলিকে আসল মালিকদের থেকে কেড়ে নিয়ে তুলে দিয়েছিলেন দলীয় ক্যাডারদের হাতে। আওয়ামী লীগের দলীয় ক্যাডারগণ যে শুধু শিল্প-পরিচালনায় অযোগ্য ছিল তাই নয়, সীমাহীন দুর্বৃত্তও ছিল। অন্যের কোল থেকে কেড়ে আনা সন্তানের প্রতি অপহরণকারির দরদ থাকে না, তেমনি বাংলাদেশের শিল্পের প্রতি দরদ ছিল না এসব আওয়ামী ক্যাডারদের। এরা নিজেদের শ্রম ও অর্থ ব্যয়ে দেশে কোন শিল্পই গড়েনি, পাকিস্তান আমলে গড়া শিল্পকে তারা দখলে নিয়েছিল মাত্র। দখলকৃত সে শিল্প কলকারখানার উপর নিজেদের ব্যক্তিস্বার্থই প্রাধান্য পেয়েছিল। ডাকাত দলের সর্দার যেমন ডাকাতিলদ্ধ মালামালকে অন্য ডাকাতদের মাঝে বন্ঠন করে, মুজিবও তেমনি দেশের কলকারখানাগুলোকে বণ্ঠন করেছিলেন নিজ দলের সদস্যদের মাঝে। এভাবে পাকিস্তানের ২৩ বছরে অর্জিত অর্থনৈতিক অগ্রগতিকে পুরাপুরি বিধ্বস্ত করে দেয়। মুজিবের হাতে প্রতিপালিত চোরডাকাতদের কুকীর্তির কিছু উদাহরণ দেয়া যাকঃ “আদমজী জুট মিল ছিল বিশ্বের সবচেয়ে বড় পাটকল। পাটজাত দ্রব্যে বিদেশে রফতানি করে এ মিলটি শত শত কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা আয় করেছে। এ মিলটির সাথে প্রতিযোগিতারসামর্থ্য ছিল না ভারতের পাটকলগুলির। অথচ মুজিব সরকার এতো বড় একটি লাভজনক প্রতিষ্ঠানকে লোকসানী প্রতিষ্ঠানে পরিণত করে। শেখ মুজিব এ মিলের দায়িত্বে বসিয়েছিলেন তারই এক ঘনিষ্ঠ বন্ধুকে। উৎপাদন বাড়ানোর চেয়ে এ মিলের মূল কাজ হয় আওয়ামী লীগ কর্মীদের এ মিলে চাকরি দিয়ে প্রতিপালনের ব্যবস্থা করা। ১৯৭৪ সালের ২২ই মার্চ ইত্তেফাক এ মর্মে খবর ছেপেছিল যে পাট শিল্পে ২৫ হাজার বাড়তি ও ভুয়া শ্রমিক এবং ৩ হাজার ৬ শত ভুয়া কর্মকর্তা রয়েছে।” -(মুনির উদ্দীন আহমদ, ১৯৮০)।

কথা হলো, একটি মাত্র মিলে যদি ২৫ হাজার ভুয়া শ্রমিক দেখিয়ে রাজনৈতিক ক্যাডার পালনের ব্যবস্থা করা হয় তবে সে কারখানা যত লাভজনকই হোক তা কি টিকে থাকতে পারে? এসব ভূয়া কর্মীরা লুটপাট ছাড়া এ মিলের আর কোন খেদমতই করেনি। সে লুটপাটেরই এক করুন চিত্র ছেপেছিল সে সময়ের দৈনিক গণকন্ঠ ১৯৭২ সালের ২৭ অক্টোবর সংখ্যায়। শিরোনামটি ছিল, “আদমজী জুট মিলের ওয়ার্কশপে এলাহী কান্ডঃ  প্রায় দেড় লক্ষ টাকার খুচরা যন্ত্র গোপনে বিক্রি।” বিরামহীন লুটের মাধ্যমে এ বিশ্ববিখ্যাত মিলটি তারা অচল করে দিয়েছে। অথচ এ মিলের মুনাফা দিয়ে এক সময় দেশে আরো অনেক কলকারখানা গড়া হয়েছিল। গড়ে উঠেছিল বহু স্কুল-কলেজ ও জনকল্যাণমূলক প্রতিষ্ঠান। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকারের দুর্নীতি ও ভারত-তোষণ নীতির ফলে অসম্ভব হয় এ মিলটির নিজের পক্ষে বেঁচে থাকাটি। শুধু আদমজী জুটমিলই নয়, ধ্বংসের মুখোমুখি হয় অন্যান্য কলকারখানাগুলিও। একের পর এক পাটের গুদামে আগুন লাগানো হয়েছে। বাংলাদেশের পাটশিল্প এভাবে ধ্বংস হওয়াতে রম-রমা হয়েছে ভারতীয় পাটকলগুলো। তারা তখন সহজেই দখল করে নেয় পাটজাত দ্রব্যের আন্তর্জাতিক বাজার। এমন কি বাংলাদেশ সরকার ১৯৭৪ সালে ভারতের সাথে চুক্তি করে পাট রপ্তানির অধিকার ভারতের হাতে সঁপে দেয়। আর এর ফলে ৫৯ হাজার জুটবেলিং শ্রমিক বেকার হয়ে যায়।- (গণকন্ঠ, জুন ১২,১৯৭৪)। পাকিস্তান আমলে ভারত এমনটি কি কখনো কল্পনা করেছে? শুধু বড় বড় কলকারখানাই নয়, একই রূপ দুর্নীতির মাধ্যমে ধ্বংস করা হয়েছিল বাংলাদেশের কুটির শিল্প। সূতা আমদানি ও তার বিতরণ আওয়ামী লীগ কর্মীদের হাতে দিয়ে প্রকৃত তাঁতীদের হাতে ন্যায্য দামে ও সঠিক মূল্যে সূতা পৌঁছানোর ব্যবস্থা অসম্ভব করেছিল। ফলে ভারতীয় সস্তা ও নিম্নমানের কাপড়ের সাথে প্রতিযোগীতার সামর্থ্য হারায় বাংলাদেশের তাঁতীরা। ফলে বেকার হয়েছিল এবং দুর্ভিক্ষের মুখে পড়েছিল পাকিস্তান আমলের স্বচ্ছল তাঁতীরা। বাংলাদেশের শিল্প ও অর্থনীতির ধ্বংসে এ ছিল মুজিব ও তার সঙ্গিদের অপরাধ।

শেখ মুজিব বাংলাদেশকে নিয়ে কীরূপ স্বপ্ন দেখতেন সেটি জনগণের জানার উপায় ছিল না। কারণ, সেটি তার অদৃশ্য মনোজগতের বিষয়। তবে বাংলাদেশকে তিনি যেখানে নিয়ে গেছেন সেটি শুধু বাংলাদেশের মানুষই দেখেনি, বিশ্ববাসীও দেখেছে। দেশটির বহুহাজার বছরের ইতিহাসে এমন দুর্দশা মূলত নজিরবিহীন। এতোটা দুরবস্থায় বাংলাদেশ আর  কোন কালেই পড়েনি। তবে আওয়ামী লীগ নেতা কর্মীগণ নিজেদের এ ব্যর্থতা লুকাতে অন্যদের গায়ে কালীমা লেপনের চেষ্টা করেছে। এজন্যই একাত্তরের মিথ্যা ইতিহাস রচনায় আওয়ামী বুদ্ধিজীবীদের এতো উদ্যোগ। একাত্তরের কতজন মারা গেল সে হিসাবটুকু না নিলে কি হবে, বহু হাজার পৃষ্ঠার বহু বই লেখা হয়েছে মুজিব-বিরোধীদের খুনী ও দালাল রূপে চিত্রিত করতে। ১৯৭০’য়ের নির্বাচনের পূর্বে এ আওয়ামী পক্ষটি “পূর্ব বাংলা শ্মশান কেন?” শিরোনামে পোস্টার ছেপে সারা দেশে প্রচার করেছিল। কিন্তু তাদের কথিত সে শ্মশান আমলে পূর্ব বাংলার মানুষ কি কখনও দুর্ভিক্ষের মুখে পড়েছিল? কাপড়ের অভাবে কি মহিলাগণ মাছধরা জাল পড়েছিল? এক দিনের জন্যও কি দেশ ভিক্ষার ঝুলিতে পরিণত হয়েছিল? পাকিস্তান আমলের পূর্ব পাকিস্তানকে যারা শ্মশান বলেছিল, তারাই একাত্তরের পর দেশটিকে বদ্ধভূমি ও শ্মশান বানিয়ে বিশ্বের সামনে পেশ করেছিল।

 

অপরাধ নৈতীক মেরুদণ্ড ধ্বংসের

শেখ মুজিব গণতন্ত্র হত্যা করেছেন। দেশকে ভারতের গোলাম বানিয়েছেন। অর্থনীতিকে ধ্বংস করে দেশকে ভিক্ষার ঝুলি বানিয়েছেন। দুর্ভিক্ষ ডেকে বহু লক্ষ মানুষের জীবনে মৃত্যু ডেকে এনেছেন। তবে তার নাশকতা শুধু তাতেই সীমিত থাকেনি। মুজিবের অতি জঘন্য নাশকতাটি ছিল দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার বিরুদ্ধেও। শিক্ষাই হলো জাতির মেরুদণ্ড। মুজিব সেটিকেও ধ্বসিয়ে দিয়েছেন। জ্ঞানার্জনের কোন সহজ রাস্তা নেই; এখানে কোন ফাঁকি-বাজি চলে না। একটি দেশের মেরুদণ্ড ভাঙতে হলে সে দেশের শিক্ষাব্যবস্থা ভেঙ্গে দেয়াটাই সে জন্য যথেষ্ট। এ কাজ শত্রুদের। তাই দেশের কল্যাণে কোন নেতার সামান্যতম আগ্রহ থাকলে শিক্ষাব্যবস্থার সামান্যতম ক্ষতি হবে -এমন সিদ্ধান্ত সে নেতা কখনোই নেয় না। কিন্তু শেখ মুজিব নিয়েছিলেন। একাত্তরের যুদ্ধ চলাকালীন ৯ মাসে বাংলাদেশের স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস হয়নি। কিন্তু লেখাপড়া না হলে কি হবে শেখ মুজিব ছাত্রদের নামেমাত্র পরীক্ষা নিয়ে বা পরীক্ষা না নিয়েই পরবর্তী ক্লাসে প্রমোশনের ব্যবস্থা করলেন। ফলে যুদ্ধকালীন নয় মাসে ছাত্রদের যা শেখা উচিত সেটা শেখা ও শেখানোর আর কোন সুযোগই থাকল না। সরকার শেখানোর ব্যবস্থাও করল না। এমনকি মেডিকেল কলেজগুলোতে প্রাকটিক্যাল পরীক্ষা না নিয়ে পাসের ব্যবস্থা করা হয়। ফলে কোন জ্ঞান বিতরণ ছাড়াই প্রচুর সার্টিফিকেট বিতরণ হলো। কোন দেশের দায়িত্বশীল সরকার কি এমন সিদ্ধান্ত নিতে পারে? মুজিবের শাসনামলে পরীক্ষার হলে ব্যাপক ভাবে নকল শুরু হয়। নকল সরবরাহকারিরা তখন বই নিয়ে পরীক্ষার হলে গিয়ে হাজির হত। মুজিব সরকার সেটি রুখবার কোন ব্যবস্থাই নিল না। সেটিও কি কম দায়িত্বহীনতা?

জ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে চুরি বা দুর্নীতি শুরু হলে তার চেয়ে মারাত্মক ক্ষতি আর কি হতে পারে? তখন সে চুরিবিদ্যার প্রয়োগ শুরু হয় অফিস-আদালত ও ব্যবসা-বাণিজ্যে। তাই একটি জাতির জন্য সবচেয়ে আত্মঘাতি হলো পরীক্ষায় দূর্নীতি। কিন্তু আত্মঘাতি রাজনীতি যাদের আজীবনের পেশা তাদের কাজে এতো বড় অপরাধ কোন অপরাধই মনে হয়নি। ছাত্রদেরকে মুজিব ও তার অনুসারিগণ সচারচরই ব্যবহার করেছেন সন্ত্রাসী রাজনীতির অবৈতনিক লাঠিয়াল রূপে। তার আমলে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে তার দলীয় ছাত্রনেতাদের দ্বারা ছাত্র খুন হয়েছে প্রকাশ্যে। অন্য দলের মিটিংয়ে হামলা হয়েছে এবং হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। কিন্তু এজন্য কারো কোন শাস্তি হয়নি। বরং মুজিবের দ্বারাই সরকারি ভাবে শুরু হয় বিচারবহিঃর্ভূত হত্যার ঘটনা। তার আমলেই বিচার ছাড়া বামপন্থী নেতা সিরাজ সিকদারকে বন্দী অবস্থায় হত্যা করা হয়।

বহু কলেজের প্রিন্সিপাল পদে বসানো হয়েছিল আওয়ামী লীগের দলীয় ক্যাডারদের। অপর দিকে শিক্ষাক্ষেত্রে যে সীমাহীন অরাজকতা, দুর্নীতি ও শিক্ষাদানে চরম অবব্যবস্থা তিনি সৃষ্টি করেছিলিন সেটি বাংলাদেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি। এ সাংঘাতিক খবর ছড়িয়ে পড়িছিল বিশ্বের অন্যান্য দেশেও। ফল দাঁড়ালো, বাংলাদেশী ডিগ্রি বিদেশে মূল্য হারালো, এবং এভাবে ইজ্জত হারালো শিক্ষিতরা। ব্রিটিশ সরকারসহ বহুদেশের সরকারই বাংলাদেশের মেডিকেল কলেজগুলোর স্বীকৃতি প্রত্যাহার করে নেয়। এভাবে বহিঃবিশ্বে বেইজ্জতি বাড়ে বাংলাদেশী ডাক্তারদের এবং সে সাথে শিক্ষা ব্যবস্থারও। শেখ মুজিব এভাবে কালিমা লেপন করলেন বাংলাদেশী ডিগ্রিধারীদের মুখে। মুজিবামলে ট্রান্সপ্যারেনসী ইন্টারন্যাশনাল জন্ম নেয়নি। সেটির জন্ম হলে দুর্নীতি পরিমাপের সে আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে বাংলাদেশ যে সে আমলেও বিশাল ব্যবধানে বিশ্বে প্রথম হত, তা নিয়ে কি সন্দেহ আছে? বাংলাদেশ পরবর্তীতে দুর্নীতিতে যে ভাবে পর পর ৫ বার বিশ্বে প্রথম হয়েছে তার চর্চা বিশাল ভাবে শুরু হয়েছিল তো মুজিব আমল থেকেই।

 

অসততার মডেল

মুজিব শুধু ফ্যাসিবাদী রাজনীতিরই মডেল ছিলেন না, মডেল পেশ করেন চারিত্রিক অসততার। সে মডেলের অনুসারিগণই আজ দেশের ব্যাংক, বীমা, শেয়ার মার্কেট ও রিজার্ভ ব্যাংকের উপর ডাকাতিতে নেমেছে। ব্যক্তির সততা বড় বড় বক্তৃতায় বা কথায় ধরা পড়ে না। সমাজের অতি দুর্বৃত্ত ব্যক্তিটিও ফেরেশতার ন্যায় কথা বলতে পারে। তবে প্রতি সমাজেই সততা পরিমাপের কিছু গ্রহণযোগ্য মাপকাঠি আছে। তা হলো, তার আয় এবং গচ্ছিত সম্পদের হিসাব। একজন ভদ্রলোকের পক্ষে তার আয় ও সম্পদ কোনটাই লুকানোর বিষয় নয়। চাকরি, ব্যবসা-বাণিজ্য বা চাষাবাদ যাই সে করুক না কেন, তা থেকে যেমন তার সমুদয় আয়ের একটি হিসাব যে কেউ বের করতে পারে। তেমনি তার ঘরবাড়ি ও গচ্ছিত সম্পদের পরিমাণ কত -সেটিরও একটি হিসাব সহজে বের করা যায়। আয়ের সাথে সম্পদের সে অসঙ্গতিই পেশ করে তার সততার পরিচয়। তখন বেড়িয়ে আসে সে কতটা সৎ বা দুর্বৃত্ত। এ বিচারে বিশাল আদালত বসানো লাগে না। যার মোটা বেতনের চাকরি নাই, বিশাল ব্যবসা-বাণিজ্য নেই, পিতার জমিদারীও নাই -এমন ব্যক্তি যদি ধানমন্ডি, গুলশান বা বনানীতে বিশাল বাড়ীর মালিক হন, তখন কি গবেষণার প্রয়োজন পড়ে এটুকু বুঝতে যে লোকটি আর যাই হোক সৎ হতে পারে না? শেখ মুজিবের মৃত্যুর পর তার গৃহে প্রাপ্ত সম্পদের একটি তালিকা করা হয়। ৩০ শে অক্টোবর (১৯৭৫) দৈনিক ইত্তেফাক মোতাবেক শেখ মুজিবর রহমানের ধানমন্ডিস্থ ৩২ নং সড়কের ব্যক্তিগত বাসভবনে প্রাপ্ত সম্পদের বিররণ হলঃ

এক).হীরা, মুক্তা, প্লাটিনাম ও স্বর্ণালঙ্কর-৭ লক্ষ ৮০ হাজার টাকা

দুই).নগদ বাংলাদেশী টাকা-৯৪ হাজার ৪ শত ৬১ টাকা

তিন).ব্যক্তিগত মোটর গাড়ী-৩ টি

চার).বৈদেশিক মুদ্রা ১৭ হাজার ৫ শত টাকা (সমমূল্যের)

পাঁচ).বিদেশী রাষ্ট্র প্রদত্ত ১ লক্ষ টাকার উপহার

ছয়).বাতিলকৃত শতকী নোট-৬ শত ২১ খানা

সাত).১টি ভারী মেশিনগান,২টি হালকা মেশিনগান,৩টি এস,এম,জি,৪টি স্টেনগান,৯০ টি গ্রেনেডসহ গোলাবারুদ ইত্যাদি।

মুজিবের চরিত্র বাংলাদেশের ইতিহাসের গোপন বিষয় নয়। নিজের রাজনৈতিক ও নৈতিক সততা যাচাইয়ে বহু দলিল ও বহু প্রমাণ তিনি জনসম্মুখে রেখে গেছেন। তার রাজনৈতিক কর্ম ও আচরণ দেশী-বিদেশী কোটি কোটি মানুষ স্বচোখে দেখেছে। রাজনৈতিক চরিত্রের পাশাপাশি অকাঠ্য দলিল রয়েছে তাঁর অর্থনৈতিক চরিত্র বিচারেও। মনের কথা বা মনের আসল রূপটি গোপন করা গেলেও গোপন করা যায় না অসৎ পথে অর্জিত বিশাল সম্পদ। ব্যক্তির চরিত্র পরিমাপে এ গচ্ছিত সম্পদই হলো প্রকৃত গজ-ফিতা। একারণেই প্রতি দেশে সততা বা ন্যায়পরায়নতা যাচাইয়ে নাগরিকের গচ্ছিত সম্পদের তথ্য নেয়া হয়। বহু দেশের সরকারই কড়া নজরদারি রাখে নাগরিকদের গচ্ছিত সম্পদের উপর। তাই মুজিবের চরিত্র বিচারে এ গচ্ছিত সম্পদ যে সাক্ষ্য দেয় -সেটি কি অস্বীকার করা যায়? মুজিব ছিলেন একজন রাজনীতিবিদ। তাঁর কোন ব্যবসা বাণিজ্য ছিল না। বহু বছর কেটেছে জেলে। তাঁর পিতাও কোন বিত্তশালী লোক ছিলেন না। তিনি প্রেসিডেন্ট হয়েছেন, প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। সে সুবাদে কিছু সরকারি বেতনও পেয়েছেন। কিন্তু প্রশ্ন হলো, সরকারি বেতন যত বিশালই হোক, তা দিয়ে কি এরূপ গচ্ছিত সম্পদ গড়ে উঠে? কেনা যায় কি তিনটি মোটর গাড়ি? জমে উঠে কি লাখ লাখ টাকার সম্পদ? নির্মিত হয় কি ধানমন্ডির বিশাল বাড়ী? বাংলাদেশে যিনি সর্বোচ্চ সরকারি বেতন পান তার পক্ষেও কি এতো সম্পদের মালিক হওয়া সম্ভব? তাই প্রশ্ন হলো, কোথা থেকে তিনি পেলেন এ বিশাল সম্পদ? এ সম্পদ যে সৎ উপায়ে অর্জিত হয়নি -তা নিয়ে কি সন্দেহ থাকে? যে ব্যক্তি সম্পদ-অর্জনে সৎ নন, তিনি কি রাজনীতিতেও সৎ হতে পারেন? প্রশ্ন হলো, এমন ব্যক্তিকে কি শ্রেষ্ঠ বাঙালীর আসনে বসানো যায়? আর সেটি করলে কি জাতির ইজ্জত থাকে? থাকে না বলেই, বিলেতের মত বহু পাশ্চাত্য দেশে মিথ্যা বললে বা আয়ের সাথে সঙ্গতি নাই এমন গচ্ছিত সম্পদ ধরা পড়লে এমন ব্যক্তিকে কোন দলই মন্ত্রীত্ব দেয় না, এমন কি দলীয় সদস্যপদও দেয় না। এবং তার সংসদ সদস্যপদও থাকে না।

কোন দুর্বৃত্তকে নেতা বানালে দুর্বৃত্তের ক্ষতি হয় না, ভয়ানক ক্ষতি এবং সম্মানহানী হয় তাদের যারা তাঁকে নেতা বানায়। এটি অনেকটা দুর্গন্ধময় আবর্জনা মাথায় নিয়ে জনসম্মুখে দাঁড়ানোর মত। তাই কোন সুশীল সমাজই দুর্বৃত্তদের মাথায় তোলে না, আবর্জনার ন্যায় তাদেরকেও ইতিহাসের আঁস্তাকুড়ে ফেলে। সভ্য দেশে দুর্নীতিপরায়ন ব্যক্তির প্রকৃত স্থানটি তাই জেলে, সমাজে নয়। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আসনে তো নয়ই। দূর্নীতিব্যক্তি-চরিত্রের অতি কলংকের দিক। এমন ব্যক্তিকে জাতীয় পর্যায়ে সম্মান দিলে অসম্মান ও অপমান বাড়ে জাতির। তাতে প্রকাশ পায় জাতির অযোগ্যতা। দুর্বৃত্তি ও দুর্বৃত্তদের নির্মূলে আত্মনিয়োগ হলো মুসলিম জীবনের মিশন। ঈমানদারের জীবনে সে মিশনটি বেঁধে দিয়েছেন খোদ মহান আল্লাহতায়ালা। যারা সে মিশনে অংশ নিল তারাই পরকালে সফলকাম। পবিত্র কোরআনে তাই বলা হয়েছে, “তোমাদের মাঝে এক দল মানুষ যেন অবশ্যই থাকে যারা মানুষকে কল্যাণের দিকে ডাকবে, ন্যায়ের নির্দেশ দিবে এবং দুর্বৃত্তিকে নির্মূল করবে; তারাই হলো সফলকাম।”-(সুরা আল-ইমরান, আয়াত ১০৪)। আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের অপমান বাড়িয়েছে শুধু দেশকে তলাহীন ভিক্ষার ঝুলি বানানোর মধ্য দিয়ে নয়, অসম্মান বাড়িয়েছে অতিশয় অসাধু ব্যক্তিকে নেতার আসনে বসিয়ে।

ফিরাউনের ন্যায় স্বৈরাচারী দুর্বৃত্তকে সমাজে পূজনীয় বা সম্মনীত করে পেশ করার অপরাধ তো বিশাল। এ অপরাধে মহান আল্লাহতায়ালার কঠোর আযাব শুধু ফিরাউনের উপর আসে না, আসে তাদেরও উপর যারা তাকে নেতা গণ্য করে এবং শ্রদ্ধা দেয়। মানুষেরঈমানদারী শুধু নামায-রোযা বা হজ-যাকাত পালনে ধরা পড়ে না, ধরে পড়ে শ্রদ্ধেয়জন বা নেতা চেনার সামর্থ্যেও। মানব জীবনের এটি অতি গুরুত্বপূর্ণ লাইফস্কিল। রোজ হাশরের বিচার দিনে এ ব্যর্থতা নিয়েও বিচার হবে। মুসলিম সমাজ ও রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব হলো সে সামর্থ্যটি বাড়ানো। বাংলাদেশীদের সে ব্যর্থতা কি কম? সত্যের পথ ও সত্যপন্থী নেতাদের চেনার সামর্থ্যটি বাড়ায় নবীরাসূলগণ। সেটি বাড়ায় ইসলামী জ্ঞান, সুস্থ শিক্ষা ব্যবস্থা, ইসলামী সংস্কৃতি ও রাজনীতি। নমরুদ-ফিরাউনের ন্যায় স্বৈরাচারী দুর্বৃ্ত্তগণ কখনোই জনগণকে সে সামর্থ্য নিয়ে বেড়ে উঠতে দেয় না। কারণ,জনগণের মাঝে সে সামর্থ্য বাড়লে তাদের নিজেদের জনপ্রিয়তা ও গ্রহযোগ্যতা থাকে না। তাই ফিরাউন হযরত মূসা (আঃ)কে সে সামর্থ্য সৃষ্টির সুযোগ দেয়নি। নমরুদও দেয়নি। শেখ মুজিবও দেয়নি। মুজিব সেটি করেছে, জনগণকে কোরআনের জ্ঞান তথা ইসলাম থেকে দূরে সরানোর মধ্য দিয়ে। করেছে, ইসলামপন্থী দলগুলিকে নিষিদ্ধ করে। শুধু ইসলামের বিরুদ্ধেই নয়, বাংলাদেশের জনগণের বিরুদ্ধেও শেখ মুজিব ও তার দল আওয়ামী লীগের এটি এক বিশাল অপরাধ। অপরাধী নেতাগণ এভাবেই নিজ অপরাধের সাথে জনগণকেও টানে।

 

গ্রন্থপঞ্জি

অলি আহাদ।জাতীয় রাজনীতি ১৯৪৫ থেকে ১৯৭৫,ঢাকা:বাংলাদেশ কো-অপারেটিভ বুক সোসাইটি লিমিটেড।

আবুল মনসুর আহম্মদ।আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর,পঞ্চম সংস্করণ, ঢাকা: সৃজন প্রকাশনী লিমিটেড, ১৯৮৯।

খন্দকার ইলিয়াস।মুজিবাদ, ঢাকা: ১৯৭৩।

মুনির উদ্দীন আহমদ।বাংলাদেশঃ বাহাত্তর থেকে পঁচাত্তর,ঢাকা:জাতীয় গ্রন্থ বিতান,১৯৮০।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *